মাত্র ছয় বছর বয়সে ওস্তাদ আমজাদ আলী খান প্রথম এককভাবে হাতে সরোদ তুলে নেন। এর পর একটানা ৭০ বছর বাজিয়ে গেছেন। সরোদ নামক এই অসাধারণ যন্ত্রটিকে টিকিয়ে রাখা এবং জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে যাঁদের অসামান্য অবদান রয়েছে, তাঁদের মধ্যে আমজাদ আলী একজন। তিনি নিজেও অসংখ্য রাগ তৈরি করেছেন। অর্জন করেছেন দেশি-বিদেশি অসংখ্য পুরস্কার, ডক্টরেট, নাগরিকত্বসহ নানা সম্মাননা। সম্প্রতি 'মিথিকাল ইন্ডিয়া' নামে ভারতের একটি অনলাইন পত্রিকা তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। যেখানে সরোদের এই মায়েস্ত্রো তাঁর জীবন, সংগীতসাধনা, সরোদবাদক তাঁর দুই ছেলে, শাস্ত্রীয় সংগীত এবং সরোদের নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করেছেন। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন হাসনাত শোয়েব।
প্রশ্ন : আপনি মাত্র ছয় বছর বয়স থেকে সরোদ বাজানো শুরু করেছিলেন। এখন প্রায় সাত দশক হতে চলল আপনার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের। আপনার পূর্বপুরুষরা নিশ্চয় শত বছর ধরে এই বাদ্যযন্ত্রটির বাজানো এবং বিকাশ নিয়ে কিছু বলেছেন। আপনি আমাদের সরোদের কৌতূহল উদ্দীপক ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলুন?
ওস্তাদ আমজাদ আলী খান : সরোদ হচ্ছে সেই ধরনের বাদ্যযন্ত্রের উদাহরণ, যা গঠনগত দিক থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের দিকে প্রায় একই রকম দেখতে ভারতীয় এবং আফগান বাদ্যযন্ত্র লুটস থেকে উদ্ভূত। আজকে আমরা যে সরোদকে চিনি, তা কূলগত এবং উৎপত্তিগত দিক থেকে প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র রাবাবের বংশধর। তো, এটা হলো রাবাব, যা আদিম আফগানিস্তান, পার্সিয়া এবং আরো কিছু দেশে দেখা যেত, যাদের প্রত্যেকের আলাদা পরিচয় ও বৈচিত্র্য ছিল। মধ্য এশিয়া থেকে আগত পাঠান বাংগাশ পরিবার, তাদের কাজ এবং অবদানের ফলেই বর্তমান সময়ে ব্যবহৃত সরোদের বিকাশ। গোলাম বান্দেগি খান বাংগাশের অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ রাবাবের সঙ্গে এমন কিছু নতুন সুরমাধুর্যের উপাদান যুক্ত করা হয়, যা তার মধ্যে উচ্চমাত্রার পরিবর্তন নিয়ে আসে (এটি সম্ভব হয়েছে আঙুলের বোর্ডের ওপর ধাতব অংশ জুড়ে দেওয়া এবং পাশাপাশি প্রাণিজ অন্ত্র দিয়ে বানানো তারের পরিবর্তে ধাতব তার ব্যবহার করার ফলে)। এবং এটি ছিল সুরমাধুর্যের ধারণা, যা থেকে বাদ্যযন্ত্রটির নামকরণ করা হয় সরোদ। পার্সিয়ান ‘সরোদ’ শব্দের অর্থ হলো ‘সুরমাধুর্য’। এই নব আবিষ্কারের ফলে গোলাম বান্দেগি বাংগাশ বহুল প্রশংসিত হলেও পরে এটি পরিপূর্ণতা পায় তার পুত্র গোলাম আলী খান বাংগাশের হাত ধরে।
তাঁরা প্রত্যেকে আমাদের পূর্বপুরুষ! এই যে তথ্য এগুলোই যা আমাকে অনুপ্রেরণা দেয় : তুমি শেষ পর্যন্ত তাই, যা তোমার সংগীত। তুমি উত্তরাধিকার সূত্রে যা পেয়েছে, তা তোমার কাজের মধ্যে দেখা যাবে, শুধু ইতিহাস কিংবা তথ্যের মধ্য দিয়ে নয়।
প্রশ্ন : আপনি সরোদ বাজানো শিখেছেন আপনার বাবা হাফিজ আলী খান সাহেবের কাছ থেকে এবং আপনার পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য সরোদ বাজানোর সঙ্গে সম্পর্কিত। এটা কি কখনো আপনার কাছে বোঝা এবং স্নায়ুচাপে ভোগায়?
ওস্তাদ আমজাদ আলী খান : আমার বাবার জন্য সংগীতের বাইরে জীবনের অন্য কোনো মানে ছিল না। তাঁর জীবন নিজেই এক সংগীত এবং সংগীত হচ্ছে জীবন। এবং আমিও প্রকৃতিগতভাবে এসেছি পাঁচ পুরুষের এই সাংগীতিক ঐতিহ্যকে বহন করে নিতে, যেভাবে একটি পাখি আকাশে উড়ে। আমার বাবা, উস্তাদ হাফিজ আলী খানসাহেব সংগীতের শুদ্ধতা এবং পবিত্রতার প্রতি পূর্ণ নিবেদিত একজন মানুষের উদাহরণ, যা তাঁকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং সবকিছুর ভিত্তি হিসেবে সংগীত, মানবতা এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করতে শিখিয়েছে। তাঁর জন্য এসব একটা আরেকটার চেয়ে আলাদা কিছু ছিল না। আমার গুরু হিসেবে সংগীতের পাশাপাশি তিনি আমাকে প্রেম, সমবেদনা, মানবতা, আস্থার শক্তি সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছেন। মানবতার প্রতি তাঁর বিশ্বাস এবং আস্থা ছিল পরিপূর্ণ ও প্রশ্নাতীত। এটা নিয়ে তাঁর কোনো সন্দেহই ছিল না যে আশপাশের মানুষের প্রতি পারস্পরিক সমঝোতা এবং বিশ্বাস কখনো কেবল রাজনৈতিক প্ররোচণা বিভাজনে ভেঙে যেতে পারে না। আমি আমার বিনম্র অভিবাদন জানাতে চাই এই মানুষটার প্রতি, সংগীতের প্রতি, গুরুর প্রতি, যাঁকে আমার প্রতিদিনকার জীবনে দুনিয়ার লোকজন হাফিজ আলী খান হিসেবে জানত।
প্রশ্ন : আমরা পড়েছি, আপনি ইউরোপিয়ান শাস্ত্রীয় সংগীত এবং মোজার্ট, বিথোভেন শুনতে পছন্দ করেন। আপনার কি মনে হয়, পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিত্বশীল অর্কেস্ট্রার এই সংস্কৃতির প্রতি ভারতীয় ছাত্রদের নজর দেওয়া উচিত?
প্রশ্ন : আমরা পড়েছি, আপনি ইউরোপিয়ান শাস্ত্রীয় সংগীত এবং মোজার্ট, বিথোভেন শুনতে পছন্দ করেন। আপনার কি মনে হয়, পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিত্বশীল অর্কেস্ট্রার এই সংস্কৃতির প্রতি ভারতীয় ছাত্রদের নজর দেওয়া উচিত?
ওস্তাদ আমজাদ আলী খান : পাশ্চাত্যের সেইসব সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য আমি খুব গর্ববোধ করি এবং শ্রদ্ধা অনুভব করি। বেথোভেন, মোজার্ট, বাখ, হ্যান্ডেল, তাইকোবস্কি এদের মতো মহান সংগীতকাররা তাঁদের কিংবদন্তি কম্পোজিশন দিয়ে এখনো বেঁচে আছেন। স্কুল ও কলেজগুলোর দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীরা কী ধরনের সংগীত পছন্দ করে এবং কোনো ধরনের আর্টিস্টকে তারা প্রচারের জন্য স্কুল-কলেজে আমন্ত্রণ জানাতে চায়, তাদের খুঁজে বের করা। আমি সব সময় ইউরোপের মিউজিক পদ্ধতির প্রশংসা করি। এমনকি অতীতে আমি যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছি, সেখানে আমার বিভাগে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিকের ছাত্ররা ছিল, যারা আমাদের সংগীতজীবন থেকে শিখতে চাইত। শুধু তাই নয়, এই বসন্তে স্ট্যানফোর্ডে আমার বিভাগে কোর্সের নামই ছিল ‘শাস্ত্রীয় সংগীত : জীবনের উপায়’।
আমার উদ্দেশ্য ছিল, সংগীত শিক্ষার্থীদের ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন ও উপলব্ধি করতে শেখানো এবং প্রাচীন গুরু-শিষ্য সম্পর্কের ভেতর দিয়ে শাস্ত্রীয় সংগীতকার হিসেবে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতাটুকু তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া। আমার অতীত আবাস ইউকের ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি এবং সিয়াটলের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি, নিউইয়র্কের স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীদের জন্য যেকোনো সাংগীতিক সংস্কৃতির সব ধরনের ইন্সট্রুমেন্ট শেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। যেখানে আগে থেকেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত জানাটা বাধ্যতামূলক নয়। প্রায় এক বছরের মতো কাজ করার পর আমি এই প্রজেক্টের নাম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই সমাগম : সরোদের জন্য সম্মিলন। আমাদের নিজেদের বিশাল শিল্পসংস্কৃতির ভাণ্ডারের কিছু তাদের আত্মার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্যই এ ভাবনা ছিল। সেই সঙ্গে রাগ এবং মধ্যযুগীয় রীতিনীতির মধ্যে একটা সাধারণ মিল খুঁজে নেওয়া।
প্রশ্ন : আপনি আপনার সারা জীবন সরোদকে পশ্চিমা দুনিয়ায় বিখ্যাত করার প্রতি নিবেদন করেছেন। এখন আপনার ছেলেরা ইউরোপিয়ান, এশিয়ান ও আমেরিকান দেশগুলো ট্যুর করছেন। সরোদকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে এমন কী পরিবর্তন হয়েছে, যা আপনি আগে থেকে দেখতে পেয়েছেন?
ওস্তাদ আমজাদ আলী খান : শৈশব থেকে আমি আমার ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতে চেয়েছি, সরোদ এমন একটা যন্ত্র, যা মানবিক অনুভূতির সবটাই প্রকাশ করতে পারে... গাওয়া, চিৎকার, কম্পন কিংবা কান্নার মধ্য দিয়ে। সব ধরনের অনুভূতি। এখন পর্যন্ত এটা একটা দীর্ঘ ভ্রমণ এবং যা স্বর্গীয় বদান্যতায় ভরপুর। সরোদ গত ২৫ বছরের তুলনায় এখন অনেক বেশি অভিব্যক্তিপূর্ণ। সরোদের সুর আজ পৃথিবীর সব জায়গায় পৌঁছে গেছে। বর্তমান সময়ে, গিটার লিজেন্ড জো ওয়ালশ এবং তরুণ ডেরেক ট্রাকসের মতো তারকারা সরোদের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি আমার পুত্র আমান ও আয়ান, আমরা একসঙ্গে মিলে নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে কৈলাশ সারইয়াত্রি এবং মালালা ইউসুফজাইয়ের প্রতি সম্মানসূচক 'শান্তির জন্য রাগ' পরিবেশন করেছি।
আমি সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ, সারা ভারত এবং পৃথিবীর সব মানুষ আমাকে এবং আমার পরিবারকে ভালোবাসে। সেইসঙ্গে আমাদের ওপর তাদের অনেক প্রত্যাশাও। আমি নিশ্চিতভাবে প্রতিনিয়ত কিছু একটা খুঁজে যাচ্ছি। সবকিছু এখানেই আছে। আমাদের স্রেফ সুরটা জায়গামতো বসাতে হবে। এখন আমি ইন্টারেস্টিং কিছু প্রজেক্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। পৃথিবী আজ একটা বিশ্বগ্রামে পরিণত হয়েছে। মিউজিক্যালি, আমাদের এখনো অনেক কিছুই করার বাকি আছে। এটা একটা দীর্ঘ যাত্রা।
প্রশ্ন : আপনার সংগীতের পেছনে অনুপ্রেরণা কী? অনেক রাগ আপনি সৃষ্টি করেছেন। তো, আপনার এই সুর সৃষ্টির অনুপ্রেরণার কৃতিত্ব কাকে দিতে চান?
ওস্তাদ আমজাদ আলী খান : আমি খুব দ্বিধা এবং বিব্রতবোধ করি যখন বলি, আমি একটা রাগ কম্পোজ করেছি। এটা আমার কাছে শরমের এবং কৌশলগতভাবে অশোভন মনে হয় ‘রাগ সৃষ্টি করেছি’ বলা। একটি নতুন রাগ একটি সদ্য জন্মানো শিশুর মতো। একটা নতুন রাগ আমার জন্য কেবল নতুন কোনো স্কেল নয়। এটা এর চেয়েও বেশি কিছু, সম্ভবত জীবনের পরিচয়, যখন একটা শিশুকে গর্ভে ধারণ করা হয়। আর এ ক্ষেত্রে রাগকে প্রার্থনা করা হয়। কীভাবে তুমি রাগকে ফিরিয়ে দিতে পারো? রাগ আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারে, 'তুমি কি আমাকে চেনো? আমি বলি, 'নাহ।' তখন তাকে আমার একটা নাম দিতে হয় এবং এরপর রাগটি আমার হয়। একদম আমার সন্তানের মতো। আমি বিশ্বাস করি, এই যে প্রেরণা এটা আধ্যাত্মিক। গণেশ কল্যাণ, ললিতা ধাওয়ানি, বাপু কানুস এ রকম অনেক রাগ এভাবে আবিষ্কার করেছি। মহাত্মা গান্ধীর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে আমি বাপু কানুস কম্পোজ করি এবং প্যারিসে ইউনেস্কোর অনুষ্ঠানে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী এবং ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেল নরসিমহা রাওয়ের সামনে পারফর্ম করি। তালিকায় প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি রাগ ছিল। আমি মনে করি, সব রাগ শুধু স্বরলিপি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। যেহেতু আমাদের এখানে প্রাচীনকাল থেকে কানে শুনে শুনে শেখার রীতি, তাই অবশ্যই প্রতিটি রাগের চরিত্র এবং ভাব বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে কেউ যদি আপনার মতো শুদ্ধতা লাভ করতে চায়, তার জন্য সঠিক পদ্ধতি কী হতে পারে?
ওস্তাদ আমজাদ আলী খান : ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত এতটাই অপূর্ব এবং বিস্ময়কর যে, এর জ্ঞান এবং শুদ্ধতা অর্জনে একজন তাঁর সারা জীবন অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারে এবং তারপরও অনুভব করতে পারে সে কেবল সমুদ্রের একটা ফোঁটা কেবল স্পর্শ করতে পেরেছে। এই খোঁজা এবং আবিষ্কারের পাশাপাশি শেখাটাও কখনো বন্ধ হয় না। এই বোঝাপড়া একজন মিউজিশিয়ানের জীবনে প্রতিবছর পরিবর্তিত হতে থাকে। আমি অসংখ্য প্রতিভা দেখছি, সম্ভবত যা ২০ বছর আগেও দেখিনি। তরুণ শিল্পীরা আজকের দিনে বেশ ভাগ্যবান, তারা অসংখ্য প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছে নিজেদের কাজ এবং দক্ষতা দেখানোর জন্য। আমি আশা করব, প্রতিটি তরুণ তুর্কি তাদের জীবনের সেরা লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। প্রতিটি যুগে সেই একই ক্যানভাসে নতুন স্বাদ এবং রঙের সম্মিলন ঘটে। সংগীতও প্রতিবছর নতুন পদ্ধতি ও নতুন অনুভব খুঁজে বের করে। এখানে এমন কোনো পদ্ধতি ও কৌশল নেই, যা শাস্ত্রীয় সংগীতকে মুখে মুখে ধরে রাখার মতো করে টিকিয়ে রাখতে পারে। এবং এমন কোনো বই বা শাস্ত্র নেই, যা বলতে পারে এটি কীভাবে প্রয়োগ করতে হয়।
প্রশ্ন : আমান ও আয়ান এখন উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়েছে। আপনি কি তাদের গড়ে ওঠা সম্পর্কে বলবেন এবং তার সঙ্গে পারফর্ম করার ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে?
ওস্তাদ আমজাদ আলী খান : আমি সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাদের আমান ও আয়ানকে দিয়েছেন। যখন আমি প্রথম আমানকে কোলে নিই, তার কানের কাছে গিয়ে গান করি। দুই বছর পর আয়ান পৃথিবীতে এলে তখনো আমি একই কাজটা করি। সারকথা হলো, ওই মূহূর্ত থেকে তাদের শিক্ষা শুরু হয়। অর্থাৎ তাদের জন্মের পরপরই তাদের অনুশীলন শুরু। তারা যেদিন দুনিয়াতে আসে, সেদিন থেকেই তারা সংগীতে ডুবে যেতে শুরু করে। সম্ভবত কোনো বুদ্ধিমান পিতামাতা তাঁদের সন্তানদের একই ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতে অনুমতি দেবে না, কিন্তু সংগীত হচ্ছে সেই একমাত্র সম্পদ, যা আমি আমার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পেয়েছি, তাই সেটা তাদের দুজনের সঙ্গে সমানভাবে ভাগ করে নিতে চেয়েছি। তাদের অনুশীলনকালে আমি কখনোই তাদের আমার স্টাইল অনুকরণ করতে উৎসাহিত করিনি। সংগীতকার হিসেবে তারা যতই কামেল হয়ে উঠেছে, আমি দেখে স্বস্তি পেয়েছি। তারা দুই ভাই এমন পথ খুঁজে নিয়েছে, যা স্বতন্ত্র এবং তাদের যা শেখানো হয়েছে তার চেয়ে বরং ভিন্ন। আমি সত্যি আনন্দ লাভ করি গিটারিস্ট ডেরেক ট্রাকস, পারফেকশনিস্ট ইভালিয়ান গ্লিনি এবং সেলিস্ট ম্যাথিউ বার্লের সঙ্গে তাদের সহযোগ দেখে।
শুভলক্ষ্মী ও আমি সব সময় তাদের উন্নতি এবং সাফল্য দেখে আনন্দিত হয়েছি। আল্লাহর রহমতে তারা নানামুখী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে উঠেছে। সময়ের সঙ্গে আমান ও আয়ান সংগীত জগতে একে অন্যের সবচেয়ে কাছের সহযোগী হয়ে উঠেছে। আমাদের বেশিরভাগ ট্যুর, বিশেষ করে বাইরের ট্যুরগুলোতে আমরা একসঙ্গে ছিলাম। যার ফলে আমরা একসঙ্গে দীর্ঘ গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটাতে পেরেছি, সেটা বাপ-বেটা কিংবা এবং গুরু-শিষ্য যেভাবেই হোক। নিউইর্কের কার্নেগি হল, লন্ডনের রয়েল ফেস্টিভ্যাল হল, সিডনিতে সিডনি অপেরা হাউসসহ অসংখ্য কনসার্টে আমরা একসঙ্গে ছিলাম, সব সমানভাবে স্মরণীয়।
প্রশ্ন : ভারতে এবং বিদেশে পারফর্ম করার ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য বৈসাদৃশ্যের কথা বলুন?
ওস্তাদ আমজাদ আলী খান : পৃথিবীর প্রতিটি অংশে নিজস্ব কিছু স্বকীয়তা রয়েছে। যেমন ভারতে আমরা সব সময় 'কেয়া বাত হে' কিংবা 'সুবহানাল্লাহ' এই ধরনের বাক্য ব্যবহার করি। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্যের কনসেপ্ট হলো দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো কিংবা সংগীত চলাকালে সামনে দিয়ে না হাঁটা, যা আমাদের তাদের কাছ থেকে শেখা প্রয়োজন।
সংগীতের সবচেয়ে অসাধারণ সত্যটা হলো, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে সাতটি সুরের ওপরই এর ভিত্তি দাঁড়িয়ে। সেই অপূর্ব নোটগুলো হলো ‘সা রে গা মা পা ধা নি সা’ অথবা ‘ডো রে মি ফা সো লা আ তি’
প্রশ্ন : তরুণ সংগীতকার, যারা স্ব-স্ব শিল্পক্ষেত্রে সফলতা লাভ করতে চান, তাঁদের জন্য কোনো উপদেশ?
ওস্তাদ আমজাদ আলী খান : সংগীত মন এবং শরীর উভয়ের জন্য দরকারি। বিশুদ্ধ সংগীত, যেমন—সরোদ, ভায়োলিন এসব গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়, মনের সূক্ষ্ম ভারসাম্যহীনতাকে ঠিক করতে। যা আমরা প্রতিদিনের আধুনিক জীবনযাত্রায় পেয়ে থাকি। শান্তি এবং স্বস্তি খোঁজার লক্ষ্যে আজকের দিনে মানুষকে আগের চেয়ে অনেক বেশি চিন্তা, অস্থিরতা, হতাশা এবং সংকটের মোকাবিলা করতে হয়। সংগীত যে কাউকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে। সরোদের মতো সংগীতের ইতিবাচক প্রভাব পেতে নির্দিষ্ট ভলিউমে এবং গভীর মনোযোগের সঙ্গে শোনা উচিত। সংগীত এমন বিশাল এক সম্পদ, যা আমি আমার পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পেয়েছি; যা আমি সব সময় আমার শিষ্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করি।
No comments:
Post a Comment
Thank you for your message, I see all your messages, it is not possible to reply many times due to busyness, I hope I will reply to everyone in time, thank you for being with me. Thanks you watching my content. Please like, Follow, Subscribe.