সংজ্ঞায় সংগীত
সংগীতের সংজ্ঞা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়,কারণ আমরা যে ধরণের গানই করিনা কেন তা সংগীত বিষয়ের আওতাভূক্ত ,এর একটা নির্দ্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকতেই হবে এবং তা আছেও। তবে এ প্রচলিত সংজ্ঞাটি আমাদের কতটুকু সন্তুষ্ট করতে পারছে তা বোধ হয় ভেবে দেখার সময় এসেছে। এবিষয়ে বিশিষ্ট সংগীত গবেষক ও চিন্তাবিদ জনাব মুত্তালিব বিশ্বাস এঁর লিখা সংগীত বিমর্শ বইটিতে তাঁর প্রদত্ত মতামত তুলে ধরছি-
সংগীতের ব্যাপারে আমরা দুইভাবে সংজ্ঞাহীন। প্রথমত: প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থাদিতে প্রদত্ত সংগীত সংক্রান্ত নানান ব্যখ্যা, ভাষা, টীকা শোনা মাত্র আমরা অচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। এই আচ্ছন্নতাতেই আমাদের যুগ ও জীবন কেটে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত অন্য অর্থেও আমরা সংগীতে সংজ্ঞাহীন। এ সংজ্ঞা "সম্যকরুপে জ্ঞাপন" অর্থে যে সংজ্ঞা বুঝি তাই। আমরা সংগীতের সংজ্ঞা জানিনা। যেটাকে সংজ্ঞা জ্ঞানে বলে, বুঝিয়ে, মুখস্থ করে চলেছি সেটা যথার্থ নয়, এমনকি সংজ্ঞাই নয়।
তথাকথিত সেই সংজ্ঞাটি হল, "গীত,বাদ্য ও নৃত্যূ - এই তিনটিকে একত্রে সংগীত বলে।" সংস্কৃত ভাষায় প্রণীত গ্রন্থাদি থেকে পাওয়া যে সংজ্ঞাটি অনুবাদ করে বাংলাটি দাঁড় করানো হয়েছে সেটি হলো "গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং ত্রয়ং সঙ্গীতমুচ্যতে।"ভাষার সামান্য হের ফের করে এর অন্য বিধ রুপও আছে,যেমন"গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং ত্রিভি: সঙ্গীত মুচ্যতে"। "গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং সঙ্গীতমুচতে"এবং "গীতবাদিত্র নৃত্যানাং ত্রয়ং সঙ্গীতমুচ্যতে" এই রকম আরও।তবে অর্থবিচারে সবগুলোই অভিন্ন।
কিন্তু সংস্কৃতে পাওয়া এই সংজ্ঞাকে ধ্রুব জ্ঞান করে তার বাংলা লিখতে গিয়ে ইচ্ছায় বা অনবধানতায় যা দাঁড়িয়েছে তা সব ক্ষেত্রে শুধু যে ভিন্ন তাই নয় বিভ্রান্তিকরও। উদাহরণত গোটাতিনেকের কথা ধরা যাক যাক। কেউ বলেছেন "নৃত্য,গীত এবং বাদ্যের সমন্বয়কে সঙ্গীত বলে। কেউ বলেছেন "গীত বাদ্য ও নৃত্য - এই তিন কলার একত্র সমন্বয়কে সংগীত বলে। আবার কেউ বলেছেন "গীত,বাদ্য ও নৃত্য একত্রে নিস্পন্ন হলে যে পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাহাকে সংগীত বলে।" হয়ত সবাই একই কথা বলতে চেয়েছেন - কিন্তু ভাষার হেরফেরে বলা হয়ে গেছে অন্য কথা। তুলনামূলক বিচারে লক্ষণীয়- "সমন্বয়" একত্র সমন্বয়" এবং একত্রে নিস্পন্ন হলে যে পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাহা"- এই শব্দ ও বাক্যাংশগুলো। সমন্বয় ও একত্রে সমন্বয় কথা দুটোর মধ্যে যে সুক্ষ্ণ প্রভেদ আছে সে কথা না হয় ছেড়ে দেয়া গেল কিন্তু তৃতীয় ক্ষেত্রে যে "সোনা ফেলে আঁচলে গেরো পড়ল" - তার কি হবে? গীত বাদ্য ও নৃত্যকে কলা দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত কিনা "যে পরিবেশের সৃষ্টি হল" তাই হল সংগীত।
আরও অবাক হতে হয় যখন দেখি কোন গ্রন্থকার তাঁর গ্রন্থে এই সংজ্ঞাটি সমর্থন করে কয়েক পৃষ্ঠা পরেই লেখেন- 'স্বর ও তালবদ্ধ মনোরঞ্জক রচনাকে বলা হয় সংগীত। তখন কি তিনি নৃত্যকে দূরে রাখেন না ? শেষের কথাটিই অপেক্ষাকৃত ঠিক- এটাই যদি জানেন তিনি তবে এই প্রচলিত সংজ্ঞার ধূয়ো ধরা কেন ?
মূল সংস্কৃত সংজ্ঞাতেই ফিরে যাওয়া যাক। এই সংজ্ঞার ভিত্তি পাওয়া যায় নারদকৃত সংগীতমকরন্দ গ্রন্থে। গ্রন্থটির রচনাকাল সপ্তম থেকে একাদশ শতকের কোন এক সময় হবে বলে অনুমান করা হয়। এই গ্রন্থে সংগীত শব্দটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে, উদাহরণ হিসেবে গীত,বাদ্য ও নৃত্যের উল্লেখ করে তাদেরকে সমগোত্রীয় বলা হয়। ভিত্তি বলতে এইটুকুই।
সংগীত-মকরন্দ রচিত হবার অগের, আরো যে তিনখানি গ্রন্থের উল্ল্যেখ করা যায়, সেগুলো হচ্ছে মতঙ্গ প্রণীত বৃহদ্দেশী(পন্চম শতক)। ভারতপ্রণীত নাট্যশাস্ত্র (দ্বিতীয় শতক) এবং মুনি নারদপ্রণীত, শিক্ষা (প্রথম শতক)। এই সব গ্রন্থে সংগীত শব্দের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা ছিল বলে জানা যায়না। বরং এই জানা যায়- সেখানে 'সংগীত' নয়, গীত শব্দটির ব্যবহার ছিল। আলোচ্য সংজ্ঞাটি স্থায়ী রুপ গ্রহণ করেছিল বোধ হয়, ত্রয়োদশ শতকে শারঙ্গদেবপ্রণীত সংগীতরত্নাকর গ্রন্থে। অত:পর ষোড়শ শতকের শেষার্ধে অহোবলরচিত সংগীতপারিজাত এর মাধ্যমে এর বিস্তার হতে থাকে। বাংলাভাষায় সংগীত বিষয়ক,সম্ভবত: প্রথম, তত্বগ্রন্থ রাধামোহন সেনকৃত সংগীত তরঙ্গ-যার প্রধম প্রকাশ ১৮৩২ সনে। এই পুস্তকটির মাধ্যমেই সাধারণ বাঙ্গালী - চিত্তে সংজ্ঞাটির প্রবেশ ঘটে এবং প্রায় চিরস্থায়ী হয়ে যায়।
কিন্তু যাঁরা অসাধারণ বাঙ্গালী তাঁরা বোধ হয় সংজ্ঞাটির ব্যপারে অবচেতন মনে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। আবার কি বললে ভাল হয় তাও ঠিক করতে পারেননি বলেই, কলমটাকে একটু আধটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সংজ্ঞাটিকে ভাল করার প্রয়াস পেয়েছেন। একবার লিখে-ফেলা যুক্তাক্ষরের ওপর কলম বুলিয়ে স্পষ্ট করে তুলতে গিয়ে যে রকম দূর্দশা হয়- তাই। একটু আগেই তার নমুনা দেওয়া হয়েছে।
এপ্রসঙ্গে আরো একটা কথা সেরে যাওয়া ভাল । ধাতু প্রত্যয় ভেঙ্গে দেখলে, সম পূর্বক গৈ ধাতু যোগে সঙ্গীত নিষ্পন্ন। গৈ ধাতুর অর্থ গান করা।সুতরাং,সংগীত এর বুৎপত্তি গত অর্থ গান অন্য কথায় গীত । কিন্তু, যে সমস্ত উৎস থেকে আমরা সংগীতের আপাতগ্রাহ্য সংজ্ঞাটি পাচ্ছি -তা সংগীতের মকরন্দ হোক আর সংগীত পারিজাত কিংবা সংগীত দর্পন ই (ফকিরুল্লাহ ১৭/১৮ই শতক) হোক- এদের কোনটিকেই শাস্ত্র মানা হয় না । এগুলি গ্রন্থ মাত্র । ব্রক্ষা ভরত ,কল্লিনাথ,হনুমান-যে চারজনকে সংগীতের শাস্ত্রকার বলে মানা হচ্ছে তাদের মধ্যে একমাত্র ভরত ব্যতিরেক আর কারও দ্বারা প্রণীত শাস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি।আর ভরতপ্রণীত যে শাস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায় সেটাও আবার মূলত সংগীত শাস্ত্র নয়। নাট্যশাস্ত্র -যার মধ্যে সংগীত আংশিক বিষয় হিসেবে আলোচিত।সেখানেও সংগীত শব্দটির ব্যবহার করা হয়নি।তারবদলে 'গীত' শব্দটির ব্যবহার করা হয়েছে।
আজ অবশ্য গীত আর সংগীত সমার্থক নয়। গীত যেন সংগীতের অধীন একটা বিষয়।কিন্তু একদিন তারা একার্থক ছিল। কালক্রমে গীত যেখানে ছিল সেখানেই থেকে গেছে। আর সঙ্গীত শব্দটির অর্থবিস্তৃতি ঘটেছে। এ রকম ঘটা অভূত পূর্ব, অসাধারণ বা অযৌক্তিক কিছু নয়। বরং এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে অর্থ-বিস্তৃতির মূলে কাজ করেছে দুটি বিষয়। প্রথমটি, ওই সংজ্ঞা। যেখানে বুঝানো গীত একা নয়-সংগীত হতে হলে তাকে আরও দুটো সংগী সহকারে হাজির হতে হবে। দ্বিতীয় বিষয় গ্রীক বা ইংরেজী ম্যাজিক শব্দের সংগে আমাদের পরিচয় ঘটে যাওয়া। এই শব্দের যে ব্যাপ্তি তার বিকল্প খুঁজতে গিয়ে "সংগীত" ব্যাতিরেকে গত্যন্তর ছিলনা। একটা সদগতি হলে গ্রন্থে পাওয়া সংজ্ঞার মাধ্যমে সংস্কৃতি গ্রন্থকারেরা ওই সংজ্ঞাটি দিয়ে যেন আমাদের বাঁচার পথ তৈরী করে রেখেছিলেন। ফলে সংজ্ঞাটি নিয়ে আর কোনরুপ চিন্তা করার দরকার কিংবা ইচ্ছা হয়নি।
কিন্তু তাতে লাভ হয়নি আদৌ বরং ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। "সঙ্গীত" কে আমরা কোনক্রমেই "ম্যাজিক সমতূল্য করতে পারিনি। শুধু অভিধানিক অর্থেই তারা এক। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে ফারাক বিস্তর। অন্য দিকে সঙ্গীতকে অর্থ বিস্তৃতি দিতে গিয়ে আমরা মনকে আঁখি ঠেরেছি- যা যুগপৎ আত্মঘাতি ও অপঘাতি হয়েছে, অন্ত:ত চিন্তা বিস্তারের ক্ষেত্রে। কিন্তু সে প্রসংগ এখানে অবান্তর। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সংজ্ঞাটি আমাদের কতখানি কাজে এসেছে, কতখানি মর্যাদা পেয়েছে তা এখন খতিয়ে দেখা যেতে পারে। প্রথমত: যে সব গ্রন্থকার সংজ্ঞাটির সমর্থক তাঁদের অধিকাংশই নিজ নিজ সংগীত বিষয়ক গ্রন্থে-গীতের ওপরেই জোর দিয়েছেন, বাদ্য ও নৃতোর উপরে নয়।* বাদ্য বিশেষ করে নৃত্যে সেখানে পরিত্যাক্ত। উপরন্ত সংগীত বিষয়ক এমন কিছু গ্রন্থ আছে যেখানে - অন্যতর বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে,যেমন- নরহরি চক্রবত্তীর লেখা "সংগীত- সার সংগ্রহ । এতে আঙ্গিকাভিনয় নামেও একটা অধ্যায় আছে। সংগীত বিষয়ক ইদানিংকালের পুস্তকাদির কথাই ধরা যাক। কোন বিশেষ গ্রন্থ বা গ্রন্থকারের উল্লেখ করার প্রয়োজন নাই। কারণ সর্বত্রই একই অবস্থা। পুস্তকের নাম পড়ে এবং তার ভিতরে প্রথম দিকে লেখা সংজ্ঞা পড়ে মনে হবে- এ বইয়ের গান,বাজনা,নাচ সব কিছুর আলোচনাই আছে। কিন্তু কার্যত: গান সংক্রান্ত ব্যাপার ছাড়া সেখানে আর কিছুই নাই। বাদ্য এবং নৃত্য বিষয়ক কোন কিছু পেতে হলে অন্য পুস্তকের খোঁজ করতে হয়। তা হলে তাদের দ্বারা স্বীকৃত সংজ্ঞা অনুযায়ী এসব সম্পূর্ণ নয় বলতে হয়।
দ্বিতীয়ত: ওই সংজ্ঞা অনুযায়ী তানসেন থেকে শুরু করে আমাদের মুনশী রইসউদ্দিন প্রমূখ গুনীবরকে সংগীত শিল্পী কিংবা সংগীতজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করতে পারা যাবে কি? এঁরা গাইতেন অবশ্যই এবং আর কিছু না হোক অন্ত:তপক্ষে তানপুরা বাজাতেন কিন্তু নাচতেন বলে তো জানা যায়না। না-ই নাচলেন ,নাচতে জানতেন বলেও তো শোনা যায়না। তবে কি এঁদের তুলনায় বাউল এবং পপশিল্পীরা পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী ? প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী তাইতো হওয়া উচিত। নাচ গান বাজনা তো সেখানে একত্রে এক দেহে নিস্পন্ন হয়, পরিবেশও সৃষ্টি হয়।
তৃতীয়ত: যখন কোন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে, যেমন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে "সংগীত ও নৃত্য কিভাগ" থাকতে দেখা যায় সেটাও কি ঠিক ? সংগীতের মধ্যেই যদি গীত বাদ্য নৃত্য থেকে থাকে তবে আবার নৃত্য কথাটির বাহুল্য প্রয়োগ কেন? কর্তৃপক্ষের মনে কি তবে সন্দেহ আছে যে- শুধু সংগীত শব্দটি দ্বারা কুলায় না ?
গীত বাদ্যে রাগ নামের একটি বিষয় আছে। যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে রাগ সংগীত এবং আপাতত আমাদের কাছে উচ্চাঙ্গ গীত ও বাদ্য তাই, যাতে রাগ আছে। তা হলে উচ্চাঙ্গ নৃত্যে রাগটি কি ভাবে থাকে ? রাগের নিরুপক যে-স্বরমূর্ছনা-( সহজভাবে বললে স্বর বিন্যাসের রীতি) নৃত্যে তার রুপায়ণ হয় কিভাবে? - সেখানে বাদি-সম্বাদি,গ্রহ,ন্যাস,আবির্ভাব,তিরোভাব, গ্রহরাদির বিবেচনা হবে কি করে আর কি ধরে ?
সংজ্ঞাটি যাঁরা মনে প্রাণে মানেন তাঁদেরকেও বলতে শোনা যায়, "গান শুনলাম" "নৃত্য দেখলাম।"" স্পষ্টত:ই প্রকাশ পায়, প্রথমটি শোনার আর দ্বিতীয়টি দেখার। মানুষের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যতার নিরিখেও তো গীত বাদ্য নত্য তাহলে এক নয়।
এর পরেও যাঁরা এই সংজ্ঞার সঙ্গে গাঁট ছড়া বেঁধে থাকবেন- তাঁদের বোধ হয় শেষ যুক্তি: এতকাল ধরে এত গুনীজনে মেনে আসছেন সেকি এমনি এমনি ? এতকাল বলতে তো তাঁরা মাত্র হাজার খানেক বছরের কথা বলছেন।(সংগীত-মকরন্দকে উৎস ধরলে)। পৃথিবী সমতল এবং সূর্য তাকে প্রদক্ষিন করছে- এই ধারণা কত হাজার বছর ধরে কত গুনীজনে মেনে এসেছেন তার কি হিসাব দেওয়া যাবে ? সে কথা স্মরণে রাখলে এবং মানলেতো কোপার্নিকাসের (১৪৭৩-১৫৪৩) কথায় কর্ণপাত না করে আজও অওড়ে যেতো "পৃথিবী সমতল এবং স্থির আর সূর্যটাই ঘুরছে।
এবার আসা যাক পৃথকভাবে নৃত্যের কথায়। প্রবন্ধের প্রথমেই লক্ষ্য যোগ্য যে, সংগীতের সংজ্ঞায় সংস্কৃত গ্রস্থে নৃত্ত এবং নৃত্য - এই দুই রকম শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই উভয় শব্দের অর্থ এক নয়। দশরুপক গ্রন্থে ধনঞ্জয় বলেছেন" ভাবাশ্রয়ং নৃত্যং,নৃত্ত তাল-লয়াশ্রয়ম্"। অর্থাৎ নৃত্য ভাব-আশ্রিত আর নৃত্ত তাল ও লয় আশ্রিত। পরবর্তীকালে অমনোযোগের কারণে এই দুই শব্দের অর্থ-পার্থক্য লোপ পায়, ফলে উভয়কে এক করে দেখার অভ্যাস গড়ে ওঠে। তাই সংগীতের সংজ্ঞায় নৃত্ত এবং নৃত্যের মধ্যে কোনাটি গ্রহণীয় সেও এক সমস্যা। নৃত্ত শব্দটিকে যথাযথ বিবেচনা করলে সমস্যটি একটু হালকা হয় বটে। তাতে গান-বাজনা করতে বসে সহজাত প্রক্রিয়া হিসেবে শিল্পীর যে অঙ্গ বিক্ষেপ ঘটে তাকে বড় জোর উপভোগ্য হিসাবে ভাবা যায়। কিন্তু তাই বলে সেই অংগবিক্ষেপকে গীত-বাদ্যের সমান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দেওয়া যায় না।
সংজ্ঞাটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা ক'রেও পারা যাচ্ছেনা। যুক্তি সেখানে বৈরী। উপাদান বিচারে,ব্যবহারিক প্রয়োগে গীত ও বাদ্যের মধ্যে গুণ ও প্রকৃতিগত সমধর্মিতা পরিলক্ষিত হলেও নৃত্যকে কিছুতেই কাছে টানা যাচ্ছে না।
প্রকৃতপক্ষে সংজ্ঞাটিই দূষণীয়। যুক্তিশাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী জাতিবাচক কোন কিছুর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে যে-বাক্য ব্যবহার করা হবে তা'তে এমন কোন শব্দ ব্যবহার করা যাবেনা যার দ্বারা সংজ্ঞার আওতাধীন কোন এক বা ততোধিক উপজাতিকে বুঝায়। অর্থাৎ উদাহরণ হিসেবে ব্যবহূতব্য শব্দের ব্যবহার সংজ্ঞার মধো থাকবেনা। গরু,ছাগল ইত্যাদি চতুষ্পদ-জাতীয় প্রাণীর উদাহরণ মাত্র। তাই বলে কেউ যদি,"গরু,ছাগল,ভেড়াকে চতুষ্পদ প্রাণী বলে" এমন একটি সংজ্ঞা দেন তবে সেটা যে-কারণে সিদ্ধ হবে না, আমাদের প্রাণ-প্রিয় সংগীত-সংজ্ঞাটিও সেই কারণেই সিদ্ধ হবে না।
তা হলে এই সংজ্ঞা ছেড়ে আমরা থাকিই বা কি করে ?
আমরা তো প্রায়সব বিষয়েই পাশ্চাত্যর দিকে তাকাই। এখানেও তাই করে দেখি, সংগীতের কিরুপ সংজ্ঞা নিয়ে তারা বেঁচে আছে। সেখানে The Universal English Dictionary তে মিউজিকের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে- সেটাকেই সবাই জানে ও মানে। সংজ্ঞাটি হল- Music is The art of combining sounds for reproduction by voice or by Instruments, so as to affect emotion. এই সংজ্ঞা বিচারে আমাদের গীত এবং বাদ্য অবশ্যই সংগীত কিন্তু নৃত্য নয়। পাশ্চাত্য বিচারে Dance is the art of bodily movement.
পাশ্চাত্যের তারা তো শ্রব্যকে আর দৃশ্যকে এক করে ফেলেনি। আমরাই বা তা করতে যাব কোন দু:খে ? অর্থনীতি,সমজনীতি,রাজনীতি,ভূতত্ব,নৃতত্ব- সব বিষয়েই যখন আমরা সংজ্ঞা পেতে চেষ্টা করছি সেই পাশ্চাত্য থেকে, তখন এখানেই বা আপত্তি থাকবে কেন ?
আমরা যদি বলি যন্ত্রে বা কন্ঠে পরিবেশনের জন্য ধ্বনি দ্বারা নির্মিত শিল্পকে সংগীত বলে তবে বোধ হয় একটি নিখুঁত সংজ্ঞা পাই। নিখুঁত এইজন্য বলা হচ্ছে যে, সংজ্ঞার উদ্দেশ্য হল,"যে যে কারণে কতকগুলো বস্তু অন্যের থেকে পৃথক কিন্তু নিজেরা পৃথক হয়েও অভিন্ন- তাদের শ্রেণীভূক্ত করা"। নাচকে গীত ও বাদ্যের সংগে একই সূত্রে গাঁথার তো কোন উপায় দেখিনা এক ছন্দ-সূত্র ছাড়া। কিন্তু ছন্দ দিয়ে ছাঁদতে গেলে তো মানুষের বহু কর্মকান্ডকেই সংগীতের মধ্যে ঢোকাতে হয়, যেমন নামতা পড়া,চলা-ফেরা,নৌকাবাইচ। এতটা উদার হওয়া কি ঠিক হবে ? নাচের সংগে সমঅধিকার নিয়ে নৌকাবাইচও সঙ্গীত হয়ে যাবে।
বহু দিনের মায়া ত্যাগ করার আগে হয়তো কেউ বলবেন নৃত্যের সঙ্গে গান-বাজনার এত বেশী সম্পর্ক, তারা এত বেশী ধরাধরি ক'রে চলে যে, তাদের তৌযাত্রিক বলতে ইচ্ছা করে অতএব নৃত্যও সংগীত। এ প্রসঙ্গে আগে একটু বলা হয়েছে,আবারও বলি ব্যান্ড না বাজিয়ে সামরিক কুচ-কাওয়াজ হয়না। তবে কি সামরিক কুচকাওয়াজও সংঙ্গীত ? মোট কথা হচ্ছে অনুষঙ্গ হিসেবে সংগীতের ব্যবহার এত বেশী ব্যাপক যে, সংগ-গুণে সংগীত-পদ বাচ্য হতে হলে -তখন আর তার সীমা-পরিসীমা থাকবে না। অনুসংগ হবার এই যে বিপুল ক্ষমতা সেটা সংগীতেরই গুণ-যাদের অনুষঙ্গ হয়, তাদের নয়। এই জন্যেই সংগীতকে "প্রোট্রেয়ান আর্ট"(The art which can lend itself to any outher art or affairs) বলা হয়।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়: এই ভাবে পরিত্যাক্তা হয়ে নৃত্যের কি দশা হবে ? আসলে কিছুই হবেনা,বরং ভালই হবে,সে পৃথক কলা হিসেবে মুক্তি ও মর্যাদা পাবে। হাজার বছর তো প্রযত্নে চলল,আর কত ? তখন তার সাথে গীত বাদ্য থাকবে তো ? অবশ্যই থাকবে, তখন বলা হবে নৃত্যের গীত বাদ্যের দরকার যেমন দরকার একটা উঠোন কিংবা মঞ্চের।
গীত বাদ্য যদি রাগ করে না থাকতে চায় ?- না থাকলে না থাকবে। নি:শব্দ নৃত্যের ধারণা বা মজা এ দেশেও ছিল- অন্য দেশেও আছে। ভরত নাট্যমের মুদ্রাতো গীত বাদ্যের অনুসারী নয়।বহু বিখ্যাত ব্যালে আছে- নৈঃশব্দই যার প্রকৃত অনুষঙ্গ। একই সংজ্ঞা ভূক্ত হলেই যে, সহগামী হতেই হবে তারই বা কি বাধ্যবাধকতা আছে ? চতুষ্পদ জন্তু হলেই কি গরু ছাগল হরিণ এক গোয়ালে থাকে ? নাকি হিরণের গোটে গরু হয়।
এ বিষয়ে আমাহেন এক অর্বাচিন নতুন করে ভেবে নতুন একটা কথা বলছে তা কিন্তু আদৌ নয়। এ নিয়ে বেশ আগেই ভাবা হয়ে গেছে। শ্রীমলাকান্ত রায়চৌধুরী সম্পাদিত "ভারতীয় সঙ্গীত কোষ" এ বলা হয়েছে "গীত বাদ্য ও নৃত্যকে সম্মিলিত ভাবে সংগীত বলা হয়। কিন্তু সঙ্গীতের প্রচলিত অর্থে কন্ঠ এবং যন্ত্রসংগীতই বুঝিতে হইবে।" এতদসত্বেও কথাটা যেন কার্ও মনে ধরছেনা-কেউ অনুসরণ করছে না। বরং নিজের পান্ডিত্যের পরিচয় দেবার মানসে বাংলাও নয়, একেবারে সেই অনুস্বর-বিসর্গ যুক্ত.. সংজ্ঞাটি আওড়াচ্ছেন। ভাবটা এমন যেন সংস্কৃতে বললে ব্যাপারটা আরও পাকা পোক্ত হবে।
শুধু স্মরণ করিযে দেবার জন্যই এই অর্বাচিন লেখক পেয়াদার মত ঢোল পিটিয়ে বলে গেছেন মাত্র যে-খাজনা দেবার শেষ তারিখ উত্তীর্ণ যেন না হয়। পেয়াদার দোষ শুধু এইটুকুই যে তিনি ইংরেজী সংজ্ঞার অনুসরণে একটি সংজ্ঞা দিয়ে ফেলেছেন- যেটা বাংলা ভাষাতে কেউ সাহস করে দিচ্ছিলেন না। এমন সংজ্ঞা গ্রহণ ও প্রনিধানযোগ্য কিনা- সে বিচারের ভার থাকল বিদগ্ধজনের উপর। এটা গ্রহণ যোগ্য না হলে তাঁরা অন্য কিছু বলুন। কিন্তু নৃত্যকে কুক্ষিগত করে যেটি বলার বদ অভ্যাস দাঁড়িয়েছে - ওইটি আর নয়।
সংগীতের সংজ্ঞা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়,কারণ আমরা যে ধরণের গানই করিনা কেন তা সংগীত বিষয়ের আওতাভূক্ত ,এর একটা নির্দ্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকতেই হবে এবং তা আছেও। তবে এ প্রচলিত সংজ্ঞাটি আমাদের কতটুকু সন্তুষ্ট করতে পারছে তা বোধ হয় ভেবে দেখার সময় এসেছে। এবিষয়ে বিশিষ্ট সংগীত গবেষক ও চিন্তাবিদ জনাব মুত্তালিব বিশ্বাস এঁর লিখা সংগীত বিমর্শ বইটিতে তাঁর প্রদত্ত মতামত তুলে ধরছি-
সংগীতের ব্যাপারে আমরা দুইভাবে সংজ্ঞাহীন। প্রথমত: প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থাদিতে প্রদত্ত সংগীত সংক্রান্ত নানান ব্যখ্যা, ভাষা, টীকা শোনা মাত্র আমরা অচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। এই আচ্ছন্নতাতেই আমাদের যুগ ও জীবন কেটে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত অন্য অর্থেও আমরা সংগীতে সংজ্ঞাহীন। এ সংজ্ঞা "সম্যকরুপে জ্ঞাপন" অর্থে যে সংজ্ঞা বুঝি তাই। আমরা সংগীতের সংজ্ঞা জানিনা। যেটাকে সংজ্ঞা জ্ঞানে বলে, বুঝিয়ে, মুখস্থ করে চলেছি সেটা যথার্থ নয়, এমনকি সংজ্ঞাই নয়।
তথাকথিত সেই সংজ্ঞাটি হল, "গীত,বাদ্য ও নৃত্যূ - এই তিনটিকে একত্রে সংগীত বলে।" সংস্কৃত ভাষায় প্রণীত গ্রন্থাদি থেকে পাওয়া যে সংজ্ঞাটি অনুবাদ করে বাংলাটি দাঁড় করানো হয়েছে সেটি হলো "গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং ত্রয়ং সঙ্গীতমুচ্যতে।"ভাষার সামান্য হের ফের করে এর অন্য বিধ রুপও আছে,যেমন"গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং ত্রিভি: সঙ্গীত মুচ্যতে"। "গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং সঙ্গীতমুচতে"এবং "গীতবাদিত্র নৃত্যানাং ত্রয়ং সঙ্গীতমুচ্যতে" এই রকম আরও।তবে অর্থবিচারে সবগুলোই অভিন্ন।
কিন্তু সংস্কৃতে পাওয়া এই সংজ্ঞাকে ধ্রুব জ্ঞান করে তার বাংলা লিখতে গিয়ে ইচ্ছায় বা অনবধানতায় যা দাঁড়িয়েছে তা সব ক্ষেত্রে শুধু যে ভিন্ন তাই নয় বিভ্রান্তিকরও। উদাহরণত গোটাতিনেকের কথা ধরা যাক যাক। কেউ বলেছেন "নৃত্য,গীত এবং বাদ্যের সমন্বয়কে সঙ্গীত বলে। কেউ বলেছেন "গীত বাদ্য ও নৃত্য - এই তিন কলার একত্র সমন্বয়কে সংগীত বলে। আবার কেউ বলেছেন "গীত,বাদ্য ও নৃত্য একত্রে নিস্পন্ন হলে যে পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাহাকে সংগীত বলে।" হয়ত সবাই একই কথা বলতে চেয়েছেন - কিন্তু ভাষার হেরফেরে বলা হয়ে গেছে অন্য কথা। তুলনামূলক বিচারে লক্ষণীয়- "সমন্বয়" একত্র সমন্বয়" এবং একত্রে নিস্পন্ন হলে যে পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাহা"- এই শব্দ ও বাক্যাংশগুলো। সমন্বয় ও একত্রে সমন্বয় কথা দুটোর মধ্যে যে সুক্ষ্ণ প্রভেদ আছে সে কথা না হয় ছেড়ে দেয়া গেল কিন্তু তৃতীয় ক্ষেত্রে যে "সোনা ফেলে আঁচলে গেরো পড়ল" - তার কি হবে? গীত বাদ্য ও নৃত্যকে কলা দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত কিনা "যে পরিবেশের সৃষ্টি হল" তাই হল সংগীত।
আরও অবাক হতে হয় যখন দেখি কোন গ্রন্থকার তাঁর গ্রন্থে এই সংজ্ঞাটি সমর্থন করে কয়েক পৃষ্ঠা পরেই লেখেন- 'স্বর ও তালবদ্ধ মনোরঞ্জক রচনাকে বলা হয় সংগীত। তখন কি তিনি নৃত্যকে দূরে রাখেন না ? শেষের কথাটিই অপেক্ষাকৃত ঠিক- এটাই যদি জানেন তিনি তবে এই প্রচলিত সংজ্ঞার ধূয়ো ধরা কেন ?
মূল সংস্কৃত সংজ্ঞাতেই ফিরে যাওয়া যাক। এই সংজ্ঞার ভিত্তি পাওয়া যায় নারদকৃত সংগীতমকরন্দ গ্রন্থে। গ্রন্থটির রচনাকাল সপ্তম থেকে একাদশ শতকের কোন এক সময় হবে বলে অনুমান করা হয়। এই গ্রন্থে সংগীত শব্দটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে, উদাহরণ হিসেবে গীত,বাদ্য ও নৃত্যের উল্লেখ করে তাদেরকে সমগোত্রীয় বলা হয়। ভিত্তি বলতে এইটুকুই।
সংগীত-মকরন্দ রচিত হবার অগের, আরো যে তিনখানি গ্রন্থের উল্ল্যেখ করা যায়, সেগুলো হচ্ছে মতঙ্গ প্রণীত বৃহদ্দেশী(পন্চম শতক)। ভারতপ্রণীত নাট্যশাস্ত্র (দ্বিতীয় শতক) এবং মুনি নারদপ্রণীত, শিক্ষা (প্রথম শতক)। এই সব গ্রন্থে সংগীত শব্দের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা ছিল বলে জানা যায়না। বরং এই জানা যায়- সেখানে 'সংগীত' নয়, গীত শব্দটির ব্যবহার ছিল। আলোচ্য সংজ্ঞাটি স্থায়ী রুপ গ্রহণ করেছিল বোধ হয়, ত্রয়োদশ শতকে শারঙ্গদেবপ্রণীত সংগীতরত্নাকর গ্রন্থে। অত:পর ষোড়শ শতকের শেষার্ধে অহোবলরচিত সংগীতপারিজাত এর মাধ্যমে এর বিস্তার হতে থাকে। বাংলাভাষায় সংগীত বিষয়ক,সম্ভবত: প্রথম, তত্বগ্রন্থ রাধামোহন সেনকৃত সংগীত তরঙ্গ-যার প্রধম প্রকাশ ১৮৩২ সনে। এই পুস্তকটির মাধ্যমেই সাধারণ বাঙ্গালী - চিত্তে সংজ্ঞাটির প্রবেশ ঘটে এবং প্রায় চিরস্থায়ী হয়ে যায়।
কিন্তু যাঁরা অসাধারণ বাঙ্গালী তাঁরা বোধ হয় সংজ্ঞাটির ব্যপারে অবচেতন মনে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। আবার কি বললে ভাল হয় তাও ঠিক করতে পারেননি বলেই, কলমটাকে একটু আধটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সংজ্ঞাটিকে ভাল করার প্রয়াস পেয়েছেন। একবার লিখে-ফেলা যুক্তাক্ষরের ওপর কলম বুলিয়ে স্পষ্ট করে তুলতে গিয়ে যে রকম দূর্দশা হয়- তাই। একটু আগেই তার নমুনা দেওয়া হয়েছে।
এপ্রসঙ্গে আরো একটা কথা সেরে যাওয়া ভাল । ধাতু প্রত্যয় ভেঙ্গে দেখলে, সম পূর্বক গৈ ধাতু যোগে সঙ্গীত নিষ্পন্ন। গৈ ধাতুর অর্থ গান করা।সুতরাং,সংগীত এর বুৎপত্তি গত অর্থ গান অন্য কথায় গীত । কিন্তু, যে সমস্ত উৎস থেকে আমরা সংগীতের আপাতগ্রাহ্য সংজ্ঞাটি পাচ্ছি -তা সংগীতের মকরন্দ হোক আর সংগীত পারিজাত কিংবা সংগীত দর্পন ই (ফকিরুল্লাহ ১৭/১৮ই শতক) হোক- এদের কোনটিকেই শাস্ত্র মানা হয় না । এগুলি গ্রন্থ মাত্র । ব্রক্ষা ভরত ,কল্লিনাথ,হনুমান-যে চারজনকে সংগীতের শাস্ত্রকার বলে মানা হচ্ছে তাদের মধ্যে একমাত্র ভরত ব্যতিরেক আর কারও দ্বারা প্রণীত শাস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি।আর ভরতপ্রণীত যে শাস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায় সেটাও আবার মূলত সংগীত শাস্ত্র নয়। নাট্যশাস্ত্র -যার মধ্যে সংগীত আংশিক বিষয় হিসেবে আলোচিত।সেখানেও সংগীত শব্দটির ব্যবহার করা হয়নি।তারবদলে 'গীত' শব্দটির ব্যবহার করা হয়েছে।
আজ অবশ্য গীত আর সংগীত সমার্থক নয়। গীত যেন সংগীতের অধীন একটা বিষয়।কিন্তু একদিন তারা একার্থক ছিল। কালক্রমে গীত যেখানে ছিল সেখানেই থেকে গেছে। আর সঙ্গীত শব্দটির অর্থবিস্তৃতি ঘটেছে। এ রকম ঘটা অভূত পূর্ব, অসাধারণ বা অযৌক্তিক কিছু নয়। বরং এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে অর্থ-বিস্তৃতির মূলে কাজ করেছে দুটি বিষয়। প্রথমটি, ওই সংজ্ঞা। যেখানে বুঝানো গীত একা নয়-সংগীত হতে হলে তাকে আরও দুটো সংগী সহকারে হাজির হতে হবে। দ্বিতীয় বিষয় গ্রীক বা ইংরেজী ম্যাজিক শব্দের সংগে আমাদের পরিচয় ঘটে যাওয়া। এই শব্দের যে ব্যাপ্তি তার বিকল্প খুঁজতে গিয়ে "সংগীত" ব্যাতিরেকে গত্যন্তর ছিলনা। একটা সদগতি হলে গ্রন্থে পাওয়া সংজ্ঞার মাধ্যমে সংস্কৃতি গ্রন্থকারেরা ওই সংজ্ঞাটি দিয়ে যেন আমাদের বাঁচার পথ তৈরী করে রেখেছিলেন। ফলে সংজ্ঞাটি নিয়ে আর কোনরুপ চিন্তা করার দরকার কিংবা ইচ্ছা হয়নি।
কিন্তু তাতে লাভ হয়নি আদৌ বরং ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। "সঙ্গীত" কে আমরা কোনক্রমেই "ম্যাজিক সমতূল্য করতে পারিনি। শুধু অভিধানিক অর্থেই তারা এক। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে ফারাক বিস্তর। অন্য দিকে সঙ্গীতকে অর্থ বিস্তৃতি দিতে গিয়ে আমরা মনকে আঁখি ঠেরেছি- যা যুগপৎ আত্মঘাতি ও অপঘাতি হয়েছে, অন্ত:ত চিন্তা বিস্তারের ক্ষেত্রে। কিন্তু সে প্রসংগ এখানে অবান্তর। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সংজ্ঞাটি আমাদের কতখানি কাজে এসেছে, কতখানি মর্যাদা পেয়েছে তা এখন খতিয়ে দেখা যেতে পারে। প্রথমত: যে সব গ্রন্থকার সংজ্ঞাটির সমর্থক তাঁদের অধিকাংশই নিজ নিজ সংগীত বিষয়ক গ্রন্থে-গীতের ওপরেই জোর দিয়েছেন, বাদ্য ও নৃতোর উপরে নয়।* বাদ্য বিশেষ করে নৃত্যে সেখানে পরিত্যাক্ত। উপরন্ত সংগীত বিষয়ক এমন কিছু গ্রন্থ আছে যেখানে - অন্যতর বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে,যেমন- নরহরি চক্রবত্তীর লেখা "সংগীত- সার সংগ্রহ । এতে আঙ্গিকাভিনয় নামেও একটা অধ্যায় আছে। সংগীত বিষয়ক ইদানিংকালের পুস্তকাদির কথাই ধরা যাক। কোন বিশেষ গ্রন্থ বা গ্রন্থকারের উল্লেখ করার প্রয়োজন নাই। কারণ সর্বত্রই একই অবস্থা। পুস্তকের নাম পড়ে এবং তার ভিতরে প্রথম দিকে লেখা সংজ্ঞা পড়ে মনে হবে- এ বইয়ের গান,বাজনা,নাচ সব কিছুর আলোচনাই আছে। কিন্তু কার্যত: গান সংক্রান্ত ব্যাপার ছাড়া সেখানে আর কিছুই নাই। বাদ্য এবং নৃত্য বিষয়ক কোন কিছু পেতে হলে অন্য পুস্তকের খোঁজ করতে হয়। তা হলে তাদের দ্বারা স্বীকৃত সংজ্ঞা অনুযায়ী এসব সম্পূর্ণ নয় বলতে হয়।
দ্বিতীয়ত: ওই সংজ্ঞা অনুযায়ী তানসেন থেকে শুরু করে আমাদের মুনশী রইসউদ্দিন প্রমূখ গুনীবরকে সংগীত শিল্পী কিংবা সংগীতজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করতে পারা যাবে কি? এঁরা গাইতেন অবশ্যই এবং আর কিছু না হোক অন্ত:তপক্ষে তানপুরা বাজাতেন কিন্তু নাচতেন বলে তো জানা যায়না। না-ই নাচলেন ,নাচতে জানতেন বলেও তো শোনা যায়না। তবে কি এঁদের তুলনায় বাউল এবং পপশিল্পীরা পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী ? প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী তাইতো হওয়া উচিত। নাচ গান বাজনা তো সেখানে একত্রে এক দেহে নিস্পন্ন হয়, পরিবেশও সৃষ্টি হয়।
তৃতীয়ত: যখন কোন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে, যেমন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে "সংগীত ও নৃত্য কিভাগ" থাকতে দেখা যায় সেটাও কি ঠিক ? সংগীতের মধ্যেই যদি গীত বাদ্য নৃত্য থেকে থাকে তবে আবার নৃত্য কথাটির বাহুল্য প্রয়োগ কেন? কর্তৃপক্ষের মনে কি তবে সন্দেহ আছে যে- শুধু সংগীত শব্দটি দ্বারা কুলায় না ?
চতূর্থত: যদি কেউ নৃত্যচর্চা করে দাবী করেন, আমি সংগীত চর্চা করি কিংবা "এবারে সংগীত পরিবেশন করবেন অমুক" এই ঘোষণার পর যদি দেখা যায় অমূক নামের সেই শিল্পী নাচতে শুরু করলেন তা হলে কি ভুল হবে? সংজ্ঞানুযায়ী হবার তো কথা নয়। কিন্তু ভুল হয়েছে কিনা তা জানা যাবে শ্রোতা দর্শককে জিজ্ঞেস করলে। তাঁরা বলবেন , একি অরাজগতা। বলা হলো সংগীত আর দেখানো হল নাচ-এ কেমন কথা ? মাথা খারাপ নাকি?
তা হলে দেখা যাচ্ছে সংজ্ঞাটি যতখানি কেতাবী ততখানি বাস্তব সম্মত নয়। ওটার কার্যকারিতা লৈখিক বা মৌখিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ। এবারে আসা যাক উপাদান বিচারে। সংগতভাবেই বলা হয়ে থাকে,সংগীতের মূল উপাদান ধ্বনি বা নাদ। গীতে এবং বাদ্যে নাদ আছে বুঝি। কিন্তু নৃত্যে নাদ কোথায় ? ঘুঙুরের শব্দ ? তাল ও যন্ত্র-সংগতের ধ্বনি? ঘুঙুর খুলে রাখা যাক। সংগত থামিয়ে রাখা যাক। যেটুকু থাকলো ওটা কি নৃত্য নয়। নৃত্য হতে হলে বাদ্য কি অপরিহার্য? রান্নার কাজে হাঁড়ি, কড়াই,খুন্তি,চুলাতো আরো বেশী অপিরিহার্য- তাই বলে সেগুলোও কি খাদ্য ? তা হলে নৃত্য নাদের বিদ্যমানতা মানা যাবে কি করে ? অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালনজাত ছন্দের মধ্যে নাদের ইঙ্গিত উপ্ত আছে? কিন্তু গীত বাদ্যের নাদ তো শ্রবণযোগ্য। নৃত্যের এই নাদ শোনা যাচ্ছেনা কেন ? একেই কি তবে অনাহত নাদ বলে ? তা বললে তো আবার অন্য একটি শাস্ত্রীয় নিয়মের পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে। ওই যে বলা হয়ে থাকে, অনাহত নাদ স্বর্গের দেব-দেবীদের ব্যাপার-সেটা তো তখন আর টেকে না।গীত বাদ্যে রাগ নামের একটি বিষয় আছে। যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে রাগ সংগীত এবং আপাতত আমাদের কাছে উচ্চাঙ্গ গীত ও বাদ্য তাই, যাতে রাগ আছে। তা হলে উচ্চাঙ্গ নৃত্যে রাগটি কি ভাবে থাকে ? রাগের নিরুপক যে-স্বরমূর্ছনা-( সহজভাবে বললে স্বর বিন্যাসের রীতি) নৃত্যে তার রুপায়ণ হয় কিভাবে? - সেখানে বাদি-সম্বাদি,গ্রহ,ন্যাস,আবির্ভাব,তিরোভাব, গ্রহরাদির বিবেচনা হবে কি করে আর কি ধরে ?
সংজ্ঞাটি যাঁরা মনে প্রাণে মানেন তাঁদেরকেও বলতে শোনা যায়, "গান শুনলাম" "নৃত্য দেখলাম।"" স্পষ্টত:ই প্রকাশ পায়, প্রথমটি শোনার আর দ্বিতীয়টি দেখার। মানুষের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যতার নিরিখেও তো গীত বাদ্য নত্য তাহলে এক নয়।
এর পরেও যাঁরা এই সংজ্ঞার সঙ্গে গাঁট ছড়া বেঁধে থাকবেন- তাঁদের বোধ হয় শেষ যুক্তি: এতকাল ধরে এত গুনীজনে মেনে আসছেন সেকি এমনি এমনি ? এতকাল বলতে তো তাঁরা মাত্র হাজার খানেক বছরের কথা বলছেন।(সংগীত-মকরন্দকে উৎস ধরলে)। পৃথিবী সমতল এবং সূর্য তাকে প্রদক্ষিন করছে- এই ধারণা কত হাজার বছর ধরে কত গুনীজনে মেনে এসেছেন তার কি হিসাব দেওয়া যাবে ? সে কথা স্মরণে রাখলে এবং মানলেতো কোপার্নিকাসের (১৪৭৩-১৫৪৩) কথায় কর্ণপাত না করে আজও অওড়ে যেতো "পৃথিবী সমতল এবং স্থির আর সূর্যটাই ঘুরছে।
এবার আসা যাক পৃথকভাবে নৃত্যের কথায়। প্রবন্ধের প্রথমেই লক্ষ্য যোগ্য যে, সংগীতের সংজ্ঞায় সংস্কৃত গ্রস্থে নৃত্ত এবং নৃত্য - এই দুই রকম শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই উভয় শব্দের অর্থ এক নয়। দশরুপক গ্রন্থে ধনঞ্জয় বলেছেন" ভাবাশ্রয়ং নৃত্যং,নৃত্ত তাল-লয়াশ্রয়ম্"। অর্থাৎ নৃত্য ভাব-আশ্রিত আর নৃত্ত তাল ও লয় আশ্রিত। পরবর্তীকালে অমনোযোগের কারণে এই দুই শব্দের অর্থ-পার্থক্য লোপ পায়, ফলে উভয়কে এক করে দেখার অভ্যাস গড়ে ওঠে। তাই সংগীতের সংজ্ঞায় নৃত্ত এবং নৃত্যের মধ্যে কোনাটি গ্রহণীয় সেও এক সমস্যা। নৃত্ত শব্দটিকে যথাযথ বিবেচনা করলে সমস্যটি একটু হালকা হয় বটে। তাতে গান-বাজনা করতে বসে সহজাত প্রক্রিয়া হিসেবে শিল্পীর যে অঙ্গ বিক্ষেপ ঘটে তাকে বড় জোর উপভোগ্য হিসাবে ভাবা যায়। কিন্তু তাই বলে সেই অংগবিক্ষেপকে গীত-বাদ্যের সমান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দেওয়া যায় না।
সংজ্ঞাটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা ক'রেও পারা যাচ্ছেনা। যুক্তি সেখানে বৈরী। উপাদান বিচারে,ব্যবহারিক প্রয়োগে গীত ও বাদ্যের মধ্যে গুণ ও প্রকৃতিগত সমধর্মিতা পরিলক্ষিত হলেও নৃত্যকে কিছুতেই কাছে টানা যাচ্ছে না।
প্রকৃতপক্ষে সংজ্ঞাটিই দূষণীয়। যুক্তিশাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী জাতিবাচক কোন কিছুর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে যে-বাক্য ব্যবহার করা হবে তা'তে এমন কোন শব্দ ব্যবহার করা যাবেনা যার দ্বারা সংজ্ঞার আওতাধীন কোন এক বা ততোধিক উপজাতিকে বুঝায়। অর্থাৎ উদাহরণ হিসেবে ব্যবহূতব্য শব্দের ব্যবহার সংজ্ঞার মধো থাকবেনা। গরু,ছাগল ইত্যাদি চতুষ্পদ-জাতীয় প্রাণীর উদাহরণ মাত্র। তাই বলে কেউ যদি,"গরু,ছাগল,ভেড়াকে চতুষ্পদ প্রাণী বলে" এমন একটি সংজ্ঞা দেন তবে সেটা যে-কারণে সিদ্ধ হবে না, আমাদের প্রাণ-প্রিয় সংগীত-সংজ্ঞাটিও সেই কারণেই সিদ্ধ হবে না।
তা হলে এই সংজ্ঞা ছেড়ে আমরা থাকিই বা কি করে ?
আমরা তো প্রায়সব বিষয়েই পাশ্চাত্যর দিকে তাকাই। এখানেও তাই করে দেখি, সংগীতের কিরুপ সংজ্ঞা নিয়ে তারা বেঁচে আছে। সেখানে The Universal English Dictionary তে মিউজিকের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে- সেটাকেই সবাই জানে ও মানে। সংজ্ঞাটি হল- Music is The art of combining sounds for reproduction by voice or by Instruments, so as to affect emotion. এই সংজ্ঞা বিচারে আমাদের গীত এবং বাদ্য অবশ্যই সংগীত কিন্তু নৃত্য নয়। পাশ্চাত্য বিচারে Dance is the art of bodily movement.
পাশ্চাত্যের তারা তো শ্রব্যকে আর দৃশ্যকে এক করে ফেলেনি। আমরাই বা তা করতে যাব কোন দু:খে ? অর্থনীতি,সমজনীতি,রাজনীতি,ভূতত্ব,নৃতত্ব- সব বিষয়েই যখন আমরা সংজ্ঞা পেতে চেষ্টা করছি সেই পাশ্চাত্য থেকে, তখন এখানেই বা আপত্তি থাকবে কেন ?
আমরা যদি বলি যন্ত্রে বা কন্ঠে পরিবেশনের জন্য ধ্বনি দ্বারা নির্মিত শিল্পকে সংগীত বলে তবে বোধ হয় একটি নিখুঁত সংজ্ঞা পাই। নিখুঁত এইজন্য বলা হচ্ছে যে, সংজ্ঞার উদ্দেশ্য হল,"যে যে কারণে কতকগুলো বস্তু অন্যের থেকে পৃথক কিন্তু নিজেরা পৃথক হয়েও অভিন্ন- তাদের শ্রেণীভূক্ত করা"। নাচকে গীত ও বাদ্যের সংগে একই সূত্রে গাঁথার তো কোন উপায় দেখিনা এক ছন্দ-সূত্র ছাড়া। কিন্তু ছন্দ দিয়ে ছাঁদতে গেলে তো মানুষের বহু কর্মকান্ডকেই সংগীতের মধ্যে ঢোকাতে হয়, যেমন নামতা পড়া,চলা-ফেরা,নৌকাবাইচ। এতটা উদার হওয়া কি ঠিক হবে ? নাচের সংগে সমঅধিকার নিয়ে নৌকাবাইচও সঙ্গীত হয়ে যাবে।
বহু দিনের মায়া ত্যাগ করার আগে হয়তো কেউ বলবেন নৃত্যের সঙ্গে গান-বাজনার এত বেশী সম্পর্ক, তারা এত বেশী ধরাধরি ক'রে চলে যে, তাদের তৌযাত্রিক বলতে ইচ্ছা করে অতএব নৃত্যও সংগীত। এ প্রসঙ্গে আগে একটু বলা হয়েছে,আবারও বলি ব্যান্ড না বাজিয়ে সামরিক কুচ-কাওয়াজ হয়না। তবে কি সামরিক কুচকাওয়াজও সংঙ্গীত ? মোট কথা হচ্ছে অনুষঙ্গ হিসেবে সংগীতের ব্যবহার এত বেশী ব্যাপক যে, সংগ-গুণে সংগীত-পদ বাচ্য হতে হলে -তখন আর তার সীমা-পরিসীমা থাকবে না। অনুসংগ হবার এই যে বিপুল ক্ষমতা সেটা সংগীতেরই গুণ-যাদের অনুষঙ্গ হয়, তাদের নয়। এই জন্যেই সংগীতকে "প্রোট্রেয়ান আর্ট"(The art which can lend itself to any outher art or affairs) বলা হয়।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়: এই ভাবে পরিত্যাক্তা হয়ে নৃত্যের কি দশা হবে ? আসলে কিছুই হবেনা,বরং ভালই হবে,সে পৃথক কলা হিসেবে মুক্তি ও মর্যাদা পাবে। হাজার বছর তো প্রযত্নে চলল,আর কত ? তখন তার সাথে গীত বাদ্য থাকবে তো ? অবশ্যই থাকবে, তখন বলা হবে নৃত্যের গীত বাদ্যের দরকার যেমন দরকার একটা উঠোন কিংবা মঞ্চের।
গীত বাদ্য যদি রাগ করে না থাকতে চায় ?- না থাকলে না থাকবে। নি:শব্দ নৃত্যের ধারণা বা মজা এ দেশেও ছিল- অন্য দেশেও আছে। ভরত নাট্যমের মুদ্রাতো গীত বাদ্যের অনুসারী নয়।বহু বিখ্যাত ব্যালে আছে- নৈঃশব্দই যার প্রকৃত অনুষঙ্গ। একই সংজ্ঞা ভূক্ত হলেই যে, সহগামী হতেই হবে তারই বা কি বাধ্যবাধকতা আছে ? চতুষ্পদ জন্তু হলেই কি গরু ছাগল হরিণ এক গোয়ালে থাকে ? নাকি হিরণের গোটে গরু হয়।
এ বিষয়ে আমাহেন এক অর্বাচিন নতুন করে ভেবে নতুন একটা কথা বলছে তা কিন্তু আদৌ নয়। এ নিয়ে বেশ আগেই ভাবা হয়ে গেছে। শ্রীমলাকান্ত রায়চৌধুরী সম্পাদিত "ভারতীয় সঙ্গীত কোষ" এ বলা হয়েছে "গীত বাদ্য ও নৃত্যকে সম্মিলিত ভাবে সংগীত বলা হয়। কিন্তু সঙ্গীতের প্রচলিত অর্থে কন্ঠ এবং যন্ত্রসংগীতই বুঝিতে হইবে।" এতদসত্বেও কথাটা যেন কার্ও মনে ধরছেনা-কেউ অনুসরণ করছে না। বরং নিজের পান্ডিত্যের পরিচয় দেবার মানসে বাংলাও নয়, একেবারে সেই অনুস্বর-বিসর্গ যুক্ত.. সংজ্ঞাটি আওড়াচ্ছেন। ভাবটা এমন যেন সংস্কৃতে বললে ব্যাপারটা আরও পাকা পোক্ত হবে।
শুধু স্মরণ করিযে দেবার জন্যই এই অর্বাচিন লেখক পেয়াদার মত ঢোল পিটিয়ে বলে গেছেন মাত্র যে-খাজনা দেবার শেষ তারিখ উত্তীর্ণ যেন না হয়। পেয়াদার দোষ শুধু এইটুকুই যে তিনি ইংরেজী সংজ্ঞার অনুসরণে একটি সংজ্ঞা দিয়ে ফেলেছেন- যেটা বাংলা ভাষাতে কেউ সাহস করে দিচ্ছিলেন না। এমন সংজ্ঞা গ্রহণ ও প্রনিধানযোগ্য কিনা- সে বিচারের ভার থাকল বিদগ্ধজনের উপর। এটা গ্রহণ যোগ্য না হলে তাঁরা অন্য কিছু বলুন। কিন্তু নৃত্যকে কুক্ষিগত করে যেটি বলার বদ অভ্যাস দাঁড়িয়েছে - ওইটি আর নয়।
No comments:
Post a Comment
Thank you for your message, I see all your messages, it is not possible to reply many times due to busyness, I hope I will reply to everyone in time, thank you for being with me. Thanks you watching my content. Please like, Follow, Subscribe.