End this click

Sunday, May 7, 2017

সংজ্ঞায় সংগীত



সংজ্ঞায় সংগীত


সংজ্ঞায় সংগীত


সংগীতের সংজ্ঞা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়,কারণ আমরা যে ধরণের গানই করিনা কেন তা সংগীত বিষয়ের আওতাভূক্ত ,এর একটা নির্দ্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকতেই হবে এবং তা আছেও। তবে এ প্রচলিত সংজ্ঞাটি আমাদের কতটুকু সন্তুষ্ট করতে পারছে তা বোধ হয় ভেবে দেখার সময় এসেছে। এবিষয়ে বিশিষ্ট সংগীত গবেষক ও চিন্তাবিদ জনাব মুত্তালিব বিশ্বাস এঁর লিখা সংগীত বিমর্শ বইটিতে তাঁর প্রদত্ত মতামত তুলে ধরছি-
সংগীতের ব্যাপারে আমরা দুইভাবে সংজ্ঞাহীন। প্রথমত: প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থাদিতে প্রদত্ত সংগীত সংক্রান্ত নানান ব্যখ্যা, ভাষা, টীকা শোনা মাত্র আমরা অচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। এই আচ্ছন্নতাতেই আমাদের যুগ ও জীবন কেটে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত অন্য অর্থেও আমরা সংগীতে সংজ্ঞাহীন। এ সংজ্ঞা ‍"সম্যকরুপে জ্ঞাপন" অর্থে যে সংজ্ঞা বুঝি তাই। আমরা সংগীতের সংজ্ঞা জানিনা। যেটাকে সংজ্ঞা জ্ঞানে বলে, বুঝিয়ে, মুখস্থ করে চলেছি সেটা যথার্থ নয়, এমনকি সংজ্ঞাই নয়।
তথাকথিত সেই সংজ্ঞাটি হল, "গীত,বাদ্য ও নৃত্যূ - এই তিনটিকে একত্রে সংগীত বলে।" সংস্কৃত ভাষায় প্রণীত গ্রন্থাদি থেকে পাওয়া যে সংজ্ঞাটি অনুবাদ করে বাংলাটি দাঁড় করানো হয়েছে সেটি হলো "গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং ত্রয়ং সঙ্গীতমুচ্যতে।"ভাষার সামান্য হের ফের করে এর অন্য বিধ রুপও আছে,যেমন"গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং ত্রিভি: সঙ্গীত মুচ্যতে"। "গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং সঙ্গীতমুচতে"এবং "গীতবাদিত্র নৃত্যানাং ত্রয়ং সঙ্গীতমুচ্যতে" এই রকম আরও।তবে অর্থবিচারে সবগুলোই অভিন্ন।
কিন্তু সংস্কৃতে পাওয়া এই সংজ্ঞাকে ধ্রুব জ্ঞান করে তার বাংলা লিখতে গিয়ে ইচ্ছায় বা অনবধানতায় যা দাঁড়িয়েছে তা সব ক্ষেত্রে শুধু যে ভিন্ন তাই নয় বিভ্রান্তিকরও। উদাহরণত গোটাতিনেকের কথা ধরা যাক যাক। কেউ বলেছেন "নৃত্য,গীত এবং বাদ্যের সমন্বয়কে সঙ্গীত বলে। কেউ বলেছেন "গীত বাদ্য ও নৃত্য - এই তিন কলার একত্র সমন্বয়কে সংগীত বলে। আবার কেউ বলেছেন "গীত,বাদ্য ও নৃত্য একত্রে নিস্পন্ন হলে যে পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাহাকে সংগীত বলে।" হয়ত সবাই একই কথা বলতে চেয়েছেন - কিন্তু ভাষার হেরফেরে বলা হয়ে গেছে অন্য কথা। তুলনামূলক বিচারে লক্ষণীয়- "সমন্বয়" একত্র সমন্বয়" এবং একত্রে নিস্পন্ন হলে যে পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাহা"- এই শব্দ ও বাক্যাংশগুলো। সমন্বয় ও একত্রে সমন্বয় কথা দুটোর মধ্যে যে সুক্ষ্ণ প্রভেদ আছে সে কথা না হয় ছেড়ে দেয়া গেল কিন্তু তৃতীয় ক্ষেত্রে যে "সোনা ফেলে আঁচলে গেরো পড়ল" - তার কি হবে? গীত বাদ্য ও নৃত্যকে কলা দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত কিনা "যে পরিবেশের সৃষ্টি হল" তাই হল সংগীত।
আরও অবাক হতে হয় যখন দেখি কোন গ্রন্থকার তাঁর গ্রন্থে এই সংজ্ঞাটি সমর্থন করে কয়েক পৃষ্ঠা পরেই লেখেন- 'স্বর ও তালবদ্ধ মনোরঞ্জক রচনাকে বলা হয় সংগীত। তখন কি তিনি নৃত্যকে দূরে রাখেন না ? শেষের কথাটিই অপেক্ষাকৃত ঠিক- এটাই যদি জানেন তিনি তবে এই প্রচলিত সংজ্ঞার ধূয়ো ধরা কেন ?
মূল সংস্কৃত সংজ্ঞাতেই ফিরে যাওয়া যাক। এই সংজ্ঞার ভিত্তি পাওয়া যায় নারদকৃত সংগীতমকরন্দ গ্রন্থে। গ্রন্থটির রচনাকাল সপ্তম থেকে একাদশ শতকের কোন এক সময় হবে বলে অনুমান করা হয়। এই গ্রন্থে সংগীত শব্দটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে, উদাহরণ হিসেবে গীত,বাদ্য ও নৃত্যের উল্লেখ করে তাদেরকে সমগোত্রীয় বলা হয়। ভিত্তি বলতে এইটুকুই।
সংগীত-মকরন্দ রচিত হবার অগের, আরো যে তিনখানি গ্রন্থের উল্ল্যেখ করা যায়, সেগুলো হচ্ছে মতঙ্গ প্রণীত বৃহদ্দেশী(পন্চম শতক)। ভারতপ্রণীত নাট্যশাস্ত্র (দ্বিতীয় শতক) এবং মুনি নারদপ্রণীত, শিক্ষা (প্রথম শতক)। এই সব গ্রন্থে সংগীত শব্দের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা ছিল বলে জানা যায়না। বরং এই জানা যায়- সেখানে 'সংগীত' নয়, গীত শব্দটির ব্যবহার ছিল। আলোচ্য সংজ্ঞাটি স্থায়ী রুপ গ্রহণ করেছিল বোধ হয়, ত্রয়োদশ শতকে শারঙ্গদেবপ্রণীত সংগীতরত্নাকর গ্রন্থে। অত:পর ষোড়শ শতকের শেষার্ধে অহোবলরচিত সংগীতপারিজাত এর মাধ্যমে এর বিস্তার হতে থাকে। বাংলাভাষায় সংগীত বিষয়ক,সম্ভবত: প্রথম, তত্বগ্রন্থ রাধামোহন সেনকৃত সংগীত তরঙ্গ-যার প্রধম প্রকাশ ১৮৩২ সনে। এই পুস্তকটির মাধ্যমেই সাধারণ বাঙ্গালী - চিত্তে সংজ্ঞাটির প্রবেশ ঘটে এবং প্রায় চিরস্থায়ী হয়ে যায়।
কিন্তু যাঁরা অসাধারণ বাঙ্গালী তাঁরা বোধ হয় সংজ্ঞাটির ব্যপারে অবচেতন মনে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। আবার কি বললে ভাল হয় তাও ঠিক করতে পারেননি বলেই, কলমটাকে একটু আধটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সংজ্ঞাটিকে ভাল করার প্রয়াস পেয়েছেন। একবার লিখে-ফেলা যুক্তাক্ষরের ওপর কলম বুলিয়ে স্পষ্ট করে তুলতে গিয়ে যে রকম দূর্দশা হয়- তাই। একটু আগেই তার নমুনা দেওয়া হয়েছে।
এপ্রসঙ্গে আরো একটা কথা সেরে যাওয়া ভাল । ধাতু প্রত্যয় ভেঙ্গে দেখলে, সম পূর্বক গৈ ধাতু যোগে সঙ্গীত নিষ্পন্ন। গৈ ধাতুর অর্থ গান করা।সুতরাং,সংগীত এর বুৎপত্তি গত অর্থ গান অন্য কথায় গীত । কিন্তু, যে সমস্ত উৎস থেকে আমরা সংগীতের আপাতগ্রাহ্য সংজ্ঞাটি পাচ্ছি -তা সংগীতের মকরন্দ হোক আর সংগীত পারিজাত কিংবা সংগীত দর্পন ই (ফকিরুল্লাহ ১৭/১৮ই শতক) হোক- এদের কোনটিকেই শাস্ত্র মানা হয় না । এগুলি গ্রন্থ মাত্র । ব্রক্ষা ভরত ,কল্লিনাথ,হনুমান-যে চারজনকে সংগীতের শাস্ত্রকার বলে মানা হচ্ছে তাদের মধ্যে একমাত্র ভরত ব্যতিরেক আর কারও দ্বারা প্রণীত শাস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি।আর ভরতপ্রণীত যে শাস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায় সেটাও আবার মূলত সংগীত শাস্ত্র নয়। নাট্যশাস্ত্র -যার মধ্যে সংগীত আংশিক বিষয় হিসেবে আলোচিত।সেখানেও সংগীত শব্দটির ব্যবহার করা হয়নি।তারবদলে 'গীত' শব্দটির ব্যবহার করা হয়েছে।
আজ অবশ্য গীত আর সংগীত সমার্থক নয়। গীত যেন সংগীতের অধীন একটা বিষয়।কিন্তু একদিন তারা একার্থক ছিল। কালক্রমে গীত যেখানে ছিল সেখানেই থেকে গেছে। আর সঙ্গীত শব্দটির অর্থবিস্তৃতি ঘটেছে। এ রকম ঘটা অভূত পূর্ব, অসাধারণ বা অযৌক্তিক কিছু নয়। বরং এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে অর্থ-বিস্তৃতির মূলে কাজ করেছে দুটি বিষয়। প্রথমটি, ওই সংজ্ঞা। যেখানে বুঝানো গীত একা নয়-সংগীত হতে হলে তাকে আরও দুটো সংগী সহকারে হাজির হতে হবে। দ্বিতীয় বিষয় গ্রীক বা ইংরেজী ম্যাজিক শব্দের সংগে আমাদের পরিচয় ঘটে যাওয়া। এই শব্দের যে ব্যাপ্তি তার বিকল্প খুঁজতে গিয়ে "সংগীত" ব্যাতিরেকে গত্যন্তর ছিলনা। একটা সদগতি হলে গ্রন্থে পাওয়া সংজ্ঞার মাধ্যমে সংস্কৃতি গ্রন্থকারেরা ওই সংজ্ঞাটি দিয়ে যেন আমাদের বাঁচার পথ তৈরী করে রেখেছিলেন। ফলে সংজ্ঞাটি নিয়ে আর কোনরুপ চিন্তা করার দরকার কিংবা ইচ্ছা হয়নি।
কিন্তু তাতে লাভ হয়নি আদৌ বরং ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। "সঙ্গীত" কে আমরা কোনক্রমেই "ম্যাজিক সমতূল্য করতে পারিনি। শুধু অভিধানিক অর্থেই তারা এক। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে ফারাক বিস্তর। অন্য দিকে সঙ্গীতকে অর্থ বিস্তৃতি দিতে গিয়ে আমরা মনকে আঁখি ঠেরেছি- যা যুগপৎ আত্মঘাতি ও অপঘাতি হয়েছে, অন্ত:ত চিন্তা বিস্তারের ক্ষেত্রে। কিন্তু সে প্রসংগ এখানে অবান্তর। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সংজ্ঞাটি আমাদের কতখানি কাজে এসেছে, কতখানি মর্যাদা পেয়েছে তা এখন খতিয়ে দেখা যেতে পারে। প্রথমত: যে সব গ্রন্থকার সংজ্ঞাটির সমর্থক তাঁদের অধিকাংশই নিজ নিজ সংগীত বিষয়ক গ্রন্থে-গীতের ওপরেই জোর দিয়েছেন, বাদ্য ও নৃতোর উপরে নয়।* বাদ্য বিশেষ করে নৃত্যে সেখানে পরিত্যাক্ত। উপরন্ত সংগীত বিষয়ক এমন কিছু গ্রন্থ আছে যেখানে - অন্যতর বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে,যেমন- নরহরি চক্রবত্তীর লেখা "সংগীত- সার সংগ্রহ । এতে আঙ্গিকাভিনয় নামেও একটা অধ্যায় আছে। সংগীত বিষয়ক ইদানিংকালের পুস্তকাদির কথাই ধরা যাক। কোন বিশেষ গ্রন্থ বা গ্রন্থকারের উল্লেখ করার প্রয়োজন নাই। কারণ সর্বত্রই একই অবস্থা। পুস্তকের নাম পড়ে এবং তার ভিতরে প্রথম দিকে লেখা সংজ্ঞা পড়ে মনে হবে- এ বইয়ের গান,বাজনা,নাচ সব কিছুর আলোচনাই আছে। কিন্তু কার্যত: গান সংক্রান্ত ব্যাপার ছাড়া সেখানে আর কিছুই নাই। বাদ্য এবং নৃত্য বিষয়ক কোন কিছু পেতে হলে অন্য পুস্তকের খোঁজ করতে হয়। তা হলে তাদের দ্বারা স্বীকৃত সংজ্ঞা অনুযায়ী এসব সম্পূর্ণ নয় বলতে হয়।
দ্বিতীয়ত: ওই সংজ্ঞা অনুযায়ী তানসেন থেকে শুরু করে আমাদের মুনশী রইসউদ্দিন প্রমূখ গুনীবরকে সংগীত শিল্পী কিংবা সংগীতজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করতে পারা যাবে কি? এঁরা গাইতেন অবশ্যই এবং আর কিছু না হোক অন্ত:তপক্ষে তানপুরা বাজাতেন কিন্তু নাচতেন বলে তো জানা যায়না। না-ই নাচলেন ,নাচতে জানতেন বলেও তো শোনা যায়না। তবে কি এঁদের তুলনায় বাউল এবং পপশিল্পীরা পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী ? প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী তাইতো হওয়া উচিত। নাচ গান বাজনা তো সেখানে একত্রে এক দেহে নিস্পন্ন হয়, পরিবেশও সৃষ্টি হয়।
তৃতীয়ত: যখন কোন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে, যেমন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে "সংগীত ও নৃত্য কিভাগ" থাকতে দেখা যায় সেটাও কি ঠিক ? সংগীতের মধ্যেই যদি গীত বাদ্য নৃত্য থেকে থাকে তবে আবার নৃত্য কথাটির বাহুল্য প্রয়োগ কেন? কর্তৃপক্ষের মনে কি তবে সন্দেহ আছে যে- শুধু সংগীত শব্দটি দ্বারা কুলায় না ?

চতূর্থত: যদি কেউ নৃত্যচর্চা করে দাবী করেন, আমি সংগীত চর্চা করি কিংবা "এবারে সংগীত পরিবেশন করবেন অমুক" এই ঘোষণার পর যদি দেখা যায় অমূক নামের সেই শিল্পী নাচতে শুরু করলেন তা হলে কি ভুল হবে? সংজ্ঞানুযায়ী হবার তো কথা নয়। কিন্তু ভুল হয়েছে কিনা তা জানা যাবে শ্রোতা দর্শককে জিজ্ঞেস করলে। তাঁরা বলবেন , একি অরাজগতা। বলা হলো সংগীত আর দেখানো হল নাচ-এ কেমন কথা ? মাথা খারাপ নাকি?

তা হলে দেখা যাচ্ছে সংজ্ঞাটি যতখানি কেতাবী ততখানি বাস্তব সম্মত নয়। ওটার কার্যকারিতা লৈখিক বা মৌখিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ। এবারে আসা যাক উপাদান বিচারে। সংগতভাবেই বলা হয়ে থাকে,সংগীতের মূল উপাদান ধ্বনি বা নাদ। গীতে এবং বাদ্যে নাদ আছে বুঝি। কিন্তু নৃত্যে নাদ কোথায় ? ঘুঙুরের শব্দ ? তাল ও যন্ত্র-সংগতের ধ্বনি? ঘুঙুর খুলে রাখা যাক। সংগত থামিয়ে রাখা যাক। যেটুকু থাকলো ওটা কি নৃত্য নয়। নৃত্য হতে হলে বাদ্য কি অপরিহার্য? রান্নার কাজে হাঁড়ি, কড়াই,খুন্তি,চুলাতো আরো বেশী অপিরিহার্য- তাই বলে সেগুলোও কি খাদ্য ? তা হলে নৃত্য নাদের বিদ্যমানতা মানা যাবে কি করে ? অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালনজাত ছন্দের মধ্যে নাদের ইঙ্গিত উপ্ত আছে? কিন্তু গীত বাদ্যের নাদ তো শ্রবণযোগ্য। নৃত্যের এই নাদ শোনা যাচ্ছেনা কেন ? একেই কি তবে অনাহত নাদ বলে ? তা বললে তো আবার অন্য একটি শাস্ত্রীয় নিয়মের পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে। ওই যে বলা হয়ে থাকে, অনাহত নাদ স্বর্গের দেব-দেবীদের ব্যাপার-সেটা তো তখন আর টেকে না।
গীত বাদ্যে রাগ নামের একটি বিষয় আছে। যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে রাগ সংগীত এবং আপাতত আমাদের কাছে উচ্চাঙ্গ গীত ও বাদ্য তাই, যাতে রাগ আছে। তা হলে উচ্চাঙ্গ নৃত্যে রাগটি কি ভাবে থাকে ? রাগের নিরুপক যে-স্বরমূর্ছনা-( সহজভাবে বললে স্বর বিন্যাসের রীতি) নৃত্যে তার রুপায়ণ হয় কিভাবে? - সেখানে বাদি-সম্বাদি,গ্রহ,ন্যাস,আবির্ভাব,তিরোভাব, গ্রহরাদির বিবেচনা হবে কি করে আর কি ধরে ?
সংজ্ঞাটি যাঁরা মনে প্রাণে মানেন তাঁদেরকেও বলতে শোনা যায়, "গান শুনলাম" "নৃত্য দেখলাম।"" স্পষ্টত:ই প্রকাশ পায়, প্রথমটি শোনার আর দ্বিতীয়টি দেখার। মানুষের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যতার নিরিখেও তো গীত বাদ্য নত্য তাহলে এক নয়।
এর পরেও যাঁরা এই সংজ্ঞার সঙ্গে গাঁট ছড়া বেঁধে থাকবেন- তাঁদের বোধ হয় শেষ যুক্তি: এতকাল ধরে এত গুনীজনে মেনে আসছেন সেকি এমনি এমনি ? এতকাল বলতে তো তাঁরা মাত্র হাজার খানেক বছরের কথা বলছেন।(সংগীত-মকরন্দকে উৎস ধরলে)। পৃথিবী সমতল এবং সূর্য তাকে প্রদক্ষিন করছে- এই ধারণা কত হাজার বছর ধরে কত গুনীজনে মেনে এসেছেন তার কি হিসাব দেওয়া যাবে ? সে কথা স্মরণে রাখলে এবং মানলেতো কোপার্নিকাসের (১৪৭৩-১৫৪৩) কথায় কর্ণপাত না করে আজও অওড়ে যেতো "পৃথিবী সমতল এবং স্থির আর সূর্যটাই ঘুরছে।
এবার আসা যাক পৃথকভাবে নৃত্যের কথায়। প্রবন্ধের প্রথমেই লক্ষ্য যোগ্য যে, সংগীতের সংজ্ঞায় সংস্কৃত গ্রস্থে নৃত্ত এবং নৃত্য - এই দুই রকম শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই উভয় শব্দের অর্থ এক নয়। দশরুপক গ্রন্থে ধনঞ্জয় বলেছেন" ভাবাশ্রয়ং নৃত্যং,নৃত্ত তাল-লয়াশ্রয়ম্"। অর্থাৎ নৃত্য ভাব-আশ্রিত আর নৃত্ত তাল ও লয় আশ্রিত। পরবর্তীকালে অমনোযোগের কারণে এই দুই শব্দের অর্থ-পার্থক্য লোপ পায়, ফলে উভয়কে এক করে দেখার অভ্যাস গড়ে ওঠে। তাই সংগীতের সংজ্ঞায় নৃত্ত এবং নৃত্যের মধ্যে কোনাটি গ্রহণীয় সেও এক সমস্যা। নৃত্ত শব্দটিকে যথাযথ বিবেচনা করলে সমস্যটি একটু হালকা হয় বটে। তাতে গান-বাজনা করতে বসে সহজাত প্রক্রিয়া হিসেবে শিল্পীর যে অঙ্গ বিক্ষেপ ঘটে তাকে বড় জোর উপভোগ্য হিসাবে ভাবা যায়। কিন্তু তাই বলে সেই অংগবিক্ষেপকে গীত-বাদ্যের সমান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দেওয়া যায় না।
সংজ্ঞাটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা ক'রেও পারা যাচ্ছেনা। যুক্তি সেখানে বৈরী। উপাদান বিচারে,ব্যবহারিক প্রয়োগে গীত ও বাদ্যের মধ্যে গুণ ও প্রকৃতিগত সমধর্মিতা পরিলক্ষিত হলেও নৃত্যকে কিছুতেই কাছে টানা যাচ্ছে না।
প্রকৃতপক্ষে সংজ্ঞাটিই দূষণীয়। যুক্তিশাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী জাতিবাচক কোন কিছুর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে যে-বাক্য ব্যবহার করা হবে তা'তে এমন কোন শব্দ ব্যবহার করা যাবেনা যার দ্বারা সংজ্ঞার আওতাধীন কোন এক বা ততোধিক উপজাতিকে বুঝায়। অর্থাৎ উদাহরণ হিসেবে ব্যবহূতব্য শব্দের ব্যবহার সংজ্ঞার মধো থাকবেনা। গরু,ছাগল ইত্যাদি চতুষ্পদ-জাতীয় প্রাণীর উদাহরণ মাত্র। তাই বলে কেউ যদি,"গরু,ছাগল,ভেড়াকে চতুষ্পদ প্রাণী বলে" এমন একটি সংজ্ঞা দেন তবে সেটা যে-কারণে সিদ্ধ হবে না, আমাদের প্রাণ-প্রিয় সংগীত-সংজ্ঞাটিও সেই কারণেই সিদ্ধ হবে না।

তা হলে এই সংজ্ঞা ছেড়ে আমরা থাকিই বা কি করে ?

আমরা তো প্রায়সব বিষয়েই পাশ্চাত্যর দিকে তাকাই। এখানেও তাই করে দেখি, সংগীতের কিরুপ সংজ্ঞা নিয়ে তারা বেঁচে আছে। সেখানে The Universal English Dictionary তে মিউজিকের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে- সেটাকেই সবাই জানে ও মানে। সংজ্ঞাটি হল- Music is The art of combining sounds for reproduction by voice or by Instruments, so as to affect emotion. এই সংজ্ঞা বিচারে আমাদের গীত এবং বাদ্য অবশ্যই সংগীত কিন্তু নৃত্য নয়। পাশ্চাত্য বিচারে Dance is the art of bodily movement.
পাশ্চাত্যের তারা তো শ্রব্যকে আর দৃশ্যকে এক করে ফেলেনি। আমরাই বা তা করতে যাব কোন দু:খে ? অর্থনীতি,সমজনীতি,রাজনীতি,ভূতত্ব,নৃতত্ব- সব বিষয়েই যখন আমরা সংজ্ঞা পেতে চেষ্টা করছি সেই পাশ্চাত্য থেকে, তখন এখানেই বা আপত্তি থাকবে কেন ?
আমরা যদি বলি যন্ত্রে বা কন্ঠে পরিবেশনের জন্য ধ্বনি দ্বারা নির্মিত শিল্পকে সংগীত বলে তবে বোধ হয় একটি নিখুঁত সংজ্ঞা পাই। নিখুঁত এইজন্য বলা হচ্ছে যে, সংজ্ঞার উদ্দেশ্য হল,"যে যে কারণে কতকগুলো বস্তু অন্যের থেকে পৃথক কিন্তু নিজেরা পৃথক হয়েও অভিন্ন- তাদের শ্রেণীভূক্ত করা"। নাচকে গীত ও বাদ্যের সংগে একই সূত্রে গাঁথার তো কোন উপায় দেখিনা এক ছন্দ-সূত্র ছাড়া। কিন্তু ছন্দ দিয়ে ছাঁদতে গেলে তো মানুষের বহু কর্মকান্ডকেই সংগীতের মধ্যে ঢোকাতে হয়, যেমন নামতা পড়া,চলা-ফেরা,নৌকাবাইচ। এতটা উদার হওয়া কি ঠিক হবে ? নাচের সংগে সমঅধিকার নিয়ে নৌকাবাইচও সঙ্গীত হয়ে যাবে।
বহু দিনের মায়া ত্যাগ করার আগে হয়তো কেউ বলবেন নৃত্যের সঙ্গে গান-বাজনার এত বেশী সম্পর্ক, তারা এত বেশী ধরাধরি ক'রে চলে যে, তাদের তৌযাত্রিক বলতে ইচ্ছা করে অতএব নৃত্যও সংগীত। এ প্রসঙ্গে আগে একটু বলা হয়েছে,আবারও বলি ব্যান্ড না বাজিয়ে সামরিক কুচ-কাওয়াজ হয়না। তবে কি সামরিক কুচকাওয়াজও সংঙ্গীত ? মোট কথা হচ্ছে অনুষঙ্গ হিসেবে সংগীতের ব্যবহার এত বেশী ব্যাপক যে, সংগ-গুণে সংগীত-পদ বাচ্য হতে হলে -তখন আর তার সীমা-পরিসীমা থাকবে না। অনুসংগ হবার এই যে বিপুল ক্ষমতা সেটা সংগীতেরই গুণ-যাদের অনুষঙ্গ হয়, তাদের নয়। এই জন্যেই সংগীতকে "প্রোট্রেয়ান আর্ট"(The art which can lend itself to any outher art or affairs) বলা হয়।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়: এই ভাবে পরিত্যাক্তা হয়ে নৃত্যের কি দশা হবে ? আসলে কিছুই হবেনা,বরং ভালই হবে,সে পৃথক কলা হিসেবে মুক্তি ও মর্যাদা পাবে। হাজার বছর তো প্রযত্নে চলল,আর কত ? তখন তার সাথে গীত বাদ্য থাকবে তো ? অবশ্যই থাকবে, তখন বলা হবে নৃত্যের গীত বাদ্যের দরকার যেমন দরকার একটা উঠোন কিংবা মঞ্চের।
গীত বাদ্য যদি রাগ করে না থাকতে চায় ?- না থাকলে না থাকবে। নি:শব্দ নৃত্যের ধারণা বা মজা এ দেশেও ছিল- অন্য দেশেও আছে। ভরত নাট্যমের মুদ্রাতো গীত বাদ্যের অনুসারী নয়।বহু বিখ্যাত ব্যালে আছে- নৈঃশব্দই যার প্রকৃত অনুষঙ্গ। একই সংজ্ঞা ভূক্ত হলেই যে, সহগামী হতেই হবে তারই বা কি বাধ্যবাধকতা আছে ? চতুষ্পদ জন্তু হলেই কি গরু ছাগল হরিণ এক গোয়ালে থাকে ? নাকি হিরণের গোটে গরু হয়।
এ বিষয়ে আমাহেন এক অর্বাচিন নতুন করে ভেবে নতুন একটা কথা বলছে তা কিন্তু আদৌ নয়। এ নিয়ে বেশ আগেই ভাবা হয়ে গেছে। শ্রীমলাকান্ত রায়চৌধুরী সম্পাদিত "ভারতীয় সঙ্গীত কোষ" এ বলা হয়েছে "গীত বাদ্য ও নৃত্যকে সম্মিলিত ভাবে সংগীত বলা হয়। কিন্তু সঙ্গীতের প্রচলিত অর্থে কন্ঠ এবং যন্ত্রসংগীতই বুঝিতে হইবে।" এতদসত্বেও কথাটা যেন কার্‌ও মনে ধরছেনা-কেউ অনুসরণ করছে না। বরং নিজের পান্ডিত্যের পরিচয় দেবার মানসে বাংলাও নয়, একেবারে সেই অনুস্বর-বিসর্গ যুক্ত.. সংজ্ঞাটি আওড়াচ্ছেন। ভাবটা এমন যেন সংস্কৃতে বললে ব্যাপারটা আরও পাকা পোক্ত হবে।
শুধু স্মরণ করিযে দেবার জন্যই এই অর্বাচিন লেখক পেয়াদার মত ঢোল পিটিয়ে বলে গেছেন মাত্র যে-খাজনা দেবার শেষ তারিখ উত্তীর্ণ যেন না হয়। পেয়াদার দোষ শুধু এইটুকুই যে তিনি ইংরেজী সংজ্ঞার অনুসরণে একটি সংজ্ঞা দিয়ে ফেলেছেন- যেটা বাংলা ভাষাতে কেউ সাহস করে দিচ্ছিলেন না। এমন সংজ্ঞা গ্রহণ ও প্রনিধানযোগ্য কিনা- সে বিচারের ভার থাকল বিদগ্ধজনের উপর। এটা গ্রহণ যোগ্য না হলে তাঁরা অন্য কিছু বলুন। কিন্তু নৃত্যকে কুক্ষিগত করে যেটি বলার বদ অভ্যাস দাঁড়িয়েছে - ওইটি আর নয়।

তাল ও ছন্দ



তাল ও ছন্দ




তাল ও ছন্দ


সঙ্গীত কলাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করতে তাল একটি অপরিহার্য কলা। তালের সঠিক জ্ঞানের অভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাল একটি ভীতিপ্রদ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়মত ও প্রয়োজনীয় সংগতের অভাবে সঙ্গীত শিল্পী যেমন তাল শিল্পীকে ভয় পান, তেমনি তাল শিল্পীও ভয় পান সঙ্গীত শিল্পীকে। এ ভয়কে দূরকরতে দরকার পারস্পরিক সমঝোতা,সহযোগিতা,সাহচার্য আর সহমর্মিতা। কোন শিক্ষাথী যদি সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করার সময় থেকেই তালের সাথে চর্চা না করে তবে তার মধ্যে তাল নিয়ে একটা অহেতুক ভীতি কাজ করবে,যা আর সহজে দূর করা সম্ভব হবেনা। একারণে আমার এ স্কুলটিতে যতগুলি পাঠ সংযোজন করেছি তা তালবদ্ধ ভাবেই দেয়ার চেষ্টা করেছি,এখানে তালের তত্বীয় দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করব।
তাল: তাল হচ্ছে একটি নির্দ্দিষ্ট সময়কে নিদ্দিষ্ট ক্ষুদ্রভাগে ছন্দবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে তাল যন্ত্রে বাদনের মধ্য দিয়ে তার পুনরাবৃত্তি ঘটানো। প্রকৃতিতে আমরা যা কিছু অবলোকন করি তার সবকিছুই ছন্দবদ্ধ ভাবে একটা নিদ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘটে চলেছে অর্থাৎ সবই তালবদ্ধ। একারণে সব কিছুই আমাদের কাছে এত সুন্দর আর মনোরম বলে মনে হয়। আমরা রেলগাড়ীতে চড়লে এর প্রচন্ড শব্দের মাঝেও ঘুমিযে পড়ি কারণ এর চলার গতি ছন্দবদ্ধ ও এর গতি প্রায় সমান থাকে অথচ হঠাৎ ব্রেক কষলেই আমরা চমকে উঠি কারণ তখন চলার ছন্দ পতন ঘটে। তাই তাল হচ্ছে সঙ্গীতের প্রাণ যার বিচ্যুতি আমাদের পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের সঙ্গীত জগতে হাজারো তালের জন্ম হয়েছে আবার হারিয়েও গিয়েছে অনেক। তাল যন্ত্রও আছে হাজারো রকমের। এর সবগুলোই যে আমাদের জানতেই হবে তা নয়। প্রাথমিক ভাবে আমরা কিছুতালের সাথে যদি পরিচিত হতে পারি তবে তা আমাদের জ্ঞানের দূয়ার ধীরে ধীরে খুলে দিবে।

মাত্রা:তালের মোট সময়টিকে পরিমাপ করার জন্য যে ক্ষুদ্রতম একক ব্যবহার করে লয়কে নির্দ্দিষ্ট করা হয়, এক কথায তাই মাত্রা।

পদ বা বিভাগ: তালের প্রতিটি মাত্রা একেকটি পদ। আর তাই,এক বা একাধিক মাত্রা নিয়ে তালকে ছন্দবদ্ধভাবে সাজানোর নামই হচ্ছে পদ বা বিভাগ। তালের এই পদ বিভাজন দুই প্রকার যথা: সমপদ বিভাজন ও অসম পদ বিভাজন। এই বিভাজনের উপর ভিত্তিকরে তালকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। নিম্নে এর বিস্তারিত ব্যখ্যা করা হল।

সমপদী তাল:যে সব তালের পদবিভাগ গুলি সমান মাত্রার দ্বারা গঠিত,তাকে সমপদী তাল বলে। যেমন: দাদরা তালটি ০৬ মাত্রা দ্বারা গঠিত,এর পদবিভাগটি হচ্ছে-- ধা ধি না । না তি না।। আর্থাৎ তিন তিন করে সামান মাত্রা নিয়ে এর পদবিভাজন করা হযেছে। কাহারবা,ত্রিতাল,চৌতাল ইত্যাদিও সমপদী তাল।

বিসমপদী তাল:যে সব তালের পদবিভাগ গুলি অসমান সেই সব তালকে বিসমপদী তাল বলা হয়। যেমন তেওড়া তালটি ০৭ মাত্রার এবং এর পদবিভাজনটি হচ্ছে-- ধা ধি না । ধি না । ধি না ।। অর্থাৎ তিন দুই দুই করে অসমান ভাবে পদ বিভাজন করা হয়েছে। ঝাপতাল, ধামার ইত্যদিও বিসমপদী তাল।

লয়:তালের নির্দ্দিষ্ট সময়কালকে অবিচ্ছেদ্দ্য সমান গতিতে অতিক্রান্ত করার নাম লয়। লয় প্রধানত তিন প্রকার-০১. বিলম্বিত লয় ০২. মধ্যে লয় ০৩. দ্রুত লয়। তবে বিশেষজ্ঞ গণ মনে করেন লয় আট প্রকার। এ ছাড়াও মাত্রার ভগ্নাংশ দ্বারা গঠিত বহুপ্রকার লয় হতে পারে যেমন: আড়,কুয়ড়,বিয়াড় ইত্যাদি।

আবর্তন: কোন তালের সম থেকে সম পর্যন্ত বাজিয়ে আসাকে আবর্তন বলে। আবর্ত বা আওয়ার্দ্দা একই কথা।

তেহাই: সমান সংখ্যক মাত্রা বিশিষ্ট যে কোন বোল বা বাণী পর পর তিনবার বাজিয়ে গদের মুখে আসাকে তিহাই বলে। তেহাই দুই প্রকার। যথা: দমদার তেহাই ও বেদমদার তেহাই।
দমদার তেহাই: যে তেহাই এর মধ্যবর্তী সময়ে দম নেয়ার অবকাশ থাকে তাকে দমদার তেহাই বলে।
বেদমদার তেহাই: যে তেহাই এর মধ্যবর্তী সময়ে দম নেয়ার অবকাশ থাকেনা তাকে বেদমদার তেহাই কলে।
সম:তালেম প্রথম মাত্রাকে সম বলে। সম থেকেই তালের শুরু। স্বরলিপিতে সমকে +(যোগ) বা x(ক্রস)চিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
তালি: পদের যে সব জায়গায় তালি দিয়ে দেখানো হয় তাকে তালি বলে। তালি একটি সশব্দ ক্রিয়া বলে। এই সব স্থান ১,২,৩ ইত্যাদি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
খালি বা ফাঁক: পদের যে স্থান অনাঘাত দ্বারা প্রদর্শন করা হয় তাকে খালি বা ফাঁক বলে। ফাঁক প্রদর্শন একটি নি:শব্দ ক্রিয়া। এসব স্থান ০(শূন্য) দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।

প্রাচীনকালে সংগীত গুনীজনেরা তালের দশটি প্রাণের কথা উল্ল্যেখ করেছেন যা নিম্নরুপ:-
০১.কাল: সংগীতে আরোপিত সময়কে কাল বলে।
০২.মার্গ: মার্গ অর্থ পথ। মার্গের দ্বারা আমরা তালের বিভিন্ন স্থান অনুধাবন করতে পারি।
০৩.ক্রিয়া: হাতের দ্বারা তালি বা খালি প্রর্দশন করাকে তালের ক্রিয়া বলে। ক্রিয়া দুই প্রকার যথা: সশব্দ ক্রিয়া ও নি:শব্দ ক্রিয়া।
০৪.অংগ:অংগ অর্থ অংশ বিশেষ। এর দ্বারা তালের অংশ সমূহ চেনা যায়।
০৫.গ্রহ:তালের যে জায়গা থেকে সংগীত শুরু হয় তাকে গ্রহ বলে। গ্রহ চার প্রকার যেমন:-
ক)সম গ্রহ:কোন সংগীত যখন সম থেকে শুরু হয় কখন তাকে সম গ্রহ বলে।
খ)বিসম গ্রহ:সম ছাড়া যে কোন স্থান থেকে সংগীত শুরু হলে তাকে বিসম গ্রহ বলে।
গ)অতীত গ্রহ:প্রকৃত সম গত হওয়ার পর বিশেষ কায়দায় সম প্রদর্শন করাকে অতীত গ্রহ বলে যা আড়ি বলেও পরিচিত।
ঘ)অনাগত গ্রহ:প্রকৃত সম আসার পূর্বেই সংগীতের মাধূর্য বৃদ্ধি করার জন্য বিশেষ কায়দায় সম প্রদর্শন করাকে অনাগত গ্রহ বলে।
০৬.জাতি:দক্ষিন ভারতীয় সংগীত রীতিতে ০৫ প্রকার জাতি প্রচলিত যেমন:চতস্র,তিস্র,মিশ্র,খন্ড ও সংকীর্ন।
০৭.কলা:বোলবাণী একই হলেও বাদন শৈলীর ভিন্নতার জন্য বিভিন্ন ঘাড়ানার বাদকদের মধ্যে যে বিশেষ বাদনকৌশল পরিলক্ষিত হয় তাই কলা।
০৮.লয়:তালের নির্দ্দিষ্ট সময়কালকে অবিচ্ছেদ্দ্য সমান গতিতে অতিক্রান্ত করার নাম লয়।
০৯.যত্বি:কোন নির্দ্দিষ্ট লয় বেঁধে দেয়ার নাম হচ্ছে যত্বি। বর্তমানে এর কোন প্রচলন দেখা যায় না।
১০.প্রস্তার:প্রস্তার এর অর্থ হচ্ছে বিস্তার। বোলবাণীর বৈচিত্র আনয়নের মধোদিয়ে বিস্তার করা হয়।

বিভিন্ন প্রকার তাল ও এর বিভাগ সমূহ:


তাল সম্পর্কিত নিম্নের এই অংশ সমূহ ১৮ জানুয়ারী,১৯৮৯ ইং,সুররং একাডেমী অব ক্লাসিক্যাল মিউজিক এর ১ম ত্রৈমাসিক কর্মশিবির উপলক্ষে প্রদত্ত ওস্তাদ কামরুজ্জামান(মনি)এঁর ভাষনএর উপর ভিত্তি করে দেয়া হল। তিনি গত ২০ জুন,২০১১ইং পরলোক গমণ করেন।


একতাল:একতাল ১২ মাত্রা বিশিষ্ট একটি সমপদী তাল। এই তালটি তিন প্রকার। যথা:

ক)দ্বিমাত্রিক একতাল
খ)ত্রিমাত্রিক একতাল
গ)চতুর্মাত্রিক একতাল
এছাড়াও বিলম্বিত একতাল বাজানোর সময় এর প্রতিটি মাত্রা চার মাত্রার সমান করে টেনে বাজানো হয়,ফলে তা ৪৮ মাত্রার মত মনে হলেও মূলত: তা দ্বিমাত্রিক একতাল ১২ মাত্রার একটি বিলম্বিত রুপের ভিন্ন প্রকাশ মাত্র।

ক)দ্বিমাত্রিক একতাল: তালটি ২/২/২/২/২/২ মাত্রা করে মোট ছয়টি পদে বিভক্ত। এর চারটি তালি ও দুইটি খালি। তালি চারটি যথাক্রমে ১,৫,৯, ও ১১ মাত্রায় এবং খালি দুইটি যথাক্রমে ৩ ও ৭ মাত্রায় অবস্থিত। তালের এই প্রকারটি অনেকটা চৌতালের মত। নিম্নে এর ছন্দ বিভাগ দেয়া হল।

পদ/বিভাগ + ০ ২য় ০ ৩য় ৪র্থ
মাত্রা ০১ ০২ ০৩ ০৪ ০৫ ০৬ ০৭ ০৮ ০৯ ১০ ১১ ১২
বোল ধিন ধিন ধাগে তেরেকেটে তু না কৎ তা ধাগে তেরেকেটে ধি না

দ্বিগুন লয়:

পদ/বিভাগ + ০ ২য় ০ ৩য় ৪র্থ
মাত্রা ০১ ০২ ০৩ ০৪ ০৫ ০৬ ০৭ ০৮ ০৯ ১০ ১১ ১২
বোল ধিনধিন ধাগেতেরেকেটে তুনা কৎতা ধাগেতেরেকেটে ধিনা ধিনধিন
ধাগেতেরেকেটে


তুনা কৎতা ধাগেতেরেকেটে ধিনা



খ)ত্রিমাত্রিক একতাল:তালটি ৩/৩/৩/৩ মাত্রা করে মোট চারটি পদে বিভক্ত। এর তিনটি তালি ও একটি খালি। তালি তিনটি যথাক্রমে ১,৪ ও ১০ মাত্রায় এবং খালিটি ৭ মাত্রায় অবস্থিত। নিম্নে এর ছন্দ বিভাগ দেয়া হল।

পদ/বিভাগ +
২য় ০
৩য়

মাত্রা ০১ ০২ ০৩ ০৪ ০৫ ০৬ ০৭ ০৮ ০৯ ১০ ১১ ১২
বোল ধিন ধিন না তেরেকেটে তু না কৎ তু না তেরেকেটে ধি না



দ্বিগুন লয়:

পদ/বিভাগ + ২য় ০
৩য়
মাত্রা ০১ ০২ ০৩ ০৪ ০৫ ০৬ ০৭ ০৮ ০৯ ১০ ১১ ১২
বোল ধিনধিন নাতেরেকেটে তুনা কৎতু নাতেরেকেটে ধিনা ধিনধিন
নাতেরেকেটে


তুনা কৎতু নাতেরেকেটে ধিনা



গ)চতুর্মাত্রিক একতাল: তালটি ৪/৪/৪ মাত্রা করে তিনটি পদে বিভক্ত। এর তিনটি তালি য়থাক্রমে ১,৫ ও ৯ মাত্রায় অবস্থিত। এই প্রকারটিতে কোন খালি নাই। নিম্নে এর ছন্দ বিভাগ দেয়া হল।

পদ/বিভাগ +
২য়
৩য়
মাত্রা ০১ ০২ ০৩ ০৪ ০৫ ০৬ ০৭ ০৮ ০৯ ১০ ১১ ১২
বোল ধিন ধিন ধা ধা দেন তা তা ধিন ধাগে তেরেকেটে তুনা কৎতা



দ্বিগুন লয়:

পদ/বিভাগ + ০ ২য় ০ ৩য় ৪র্থ
মাত্রা ০১ ০২ ০৩ ০৪ ০৫ ০৬ ০৭ ০৮ ০৯ ১০ ১১ ১২
বোল ধিনধিন
ধাধা দেনতা তাধিন ধাগেতেরেকেটে তুনাকৎতা ধিনধিন ধাধা দেনতা তাধিন ধাগেতেরেকেটে তুনাকৎতা



বিলম্বিত একতাল:খেয়াল গানে এর বহুল ব্যবহার থাকায় তালটির ছন্দবিভাগ বিস্তৃত ভাবে দেয়া হল:-


+ ০১ ধিন া া া
০২ ধিন া া া
০ ০৩ ধা া গে া
০৪ তে রে কে টে
২য় ০৫ তু া া া
০৬ না া না নানা
০ ০৭ কৎ া া া
০৮ তা া া া
৩য় ০৯ ধা া গে া
১০ তে রে কে টে
৪র্থ ১১ ধিন া া া
১২ ধা া ধা ধাধা

(বি:দ্র: এই বিশেষ প্রক্রিয়ার তালটি গুনি শিক্ষক কর্তৃক তালিম গ্রহণ ছাড়া আয়ত্ত করা খুবই কঠিন বলে বিবেচিত)

তাল ঝুমরা: এটি একটি ১৪ মাত্রার বিসমপদী তাল। তালটি ৩/৪/৩/৪ করে চারটি পদে বিভক্ত। তিনটি তালি ও একটি খালি বিশিষ্ট তালটির ১,৪ ও ১১ মাত্রায় তালি এবং ৮ মাত্রয় খালি অবস্থিত। এর মধো লয়এর বোলটি নিম্নরুপ:-

পদ/বিভাগ + ২য় ০ ৩য়
মাত্রা
০১ ০২ ০৩ ০৪ ০৫ ০৬ ০৭ ০৮ ০৯ ১০ ১১ ১২ ১৩ ১৪
বোল ধিন ধিন তেরেকেটে ধিন ধিন ধাগে তেরেকেটে তিন তিন তেরেকেটে ধিন ধিন ধাগে তেরেকেটে


বিলম্বিত ঝুমরা:-


+ ০১ ধিন া া া
০২ ধিন া া া
০৩ তে রে কে টে
২য় ০৪ ধিন া া া
০৫ ধিন া া া
০৬ ধা া গে া
০৭ তে রে কে টে
০ ০৮ তিন া া া
০৯ তিন া া া
১০ তে রে কে টে
৩য় ১১ ধিন া া া
১২ ধিন া া া
১৩ ধা া গে া
১৪ তে রে কে টে






ত্রিতাল: তালটি ১৬ মাত্রা বিশিষ্ট একটি সমপদী তাল। যা ৪/৪/৪/৪ মাত্রা করে চারটি পদে বিভক্ত। তিনটি তালি ও একটি খালি বিশিষ্ট তালটির ১,৫ ও ১৩ মাত্রায় তালি এবং ৯ মাত্রায় খালি অবস্থিত। খেয়াল ও অন্যান্য গানে বহুল প্রচলিত তালটির ছন্দবিভাগ নিম্নে দেয়া হল।


পদ/বিভাগ + ২য় ০ ৩য়
মাত্রা ০১ ০২ ০৩ ০৪ ০৫ ০৬ ০৭ ০৮ ০৯ ১০ ১১ ১২ ১৩ ১৪ ১৫ ১৬
বোল ধা ধিন ধিন ধা ধা ধিন ধিন ধা না তিন তিন তা তেটে ধিন ধিন ধা

দ্বিগুন লয়:

পদ/বিভাগ + ২য় ০ ৩য়
মাত্রা ০১ ০২ ০৩ ০৪ ০৫ ০৬ ০৭ ০৮ ০৯ ১০ ১১ ১২ ১৩ ১৪ ১৫ ১৬
বোল ধাধিন ধিনধা ধাধিন ধিনধা নাতিন তিনতা তেটেধিন ধিনধা ধাধিন ধিনধা ধাধিন ধিনধা নাতিন তিনতা তেটেধিন ধিনধা



বিলম্বিত ত্রিতাল: যে কোন তালকে স্বাভাবিক লয় অপেক্ষা কম লয়ে বাজানোর নাম বিলম্বিত তাল। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত: বিশেষ ধরণের বোল বাজানো হয়,যা ঢিমা লয়কে প্রাণ্জ্ঞল ও লয়কে ধরে রাখতে সাহায্য করে। নিম্নে বিলম্বিত ত্রিতালের একটি বিশেষ ধরণের বোল দেয়া হল:-


+
০১
ধাক্রে
০২
ধিনক্রে
০৩
ধিনক্রে
০৪
ধাতিৎ
২য়
০৫
ধাগিতেটে
০৬
ধিনক্রে
০৭
ধিনক্রে
০৮
ধাতিৎ

০৯
তাক্রে
১০
তিনক্রে
১১
তিন
১২
তাতিৎ
৩য়
১৩
ধাগিতেটে
১৪
ধিনক্রে
১৫
ধিন
১৬
ধাতিৎ


লয়, মাত্রা ও তাল



লয়, মাত্রা ও তাল




লয়, মাত্রা ও তাল

সঙ্গীতের গতিকে লয় বলে। গতির তারতম্যের জন্য লয়কে তিন ভাগে ভাগ করা যায় - ১) ধীরগতির সঙ্গীতের জন্য বিলম্বিত লয়, ২) দ্রুতগতির সঙ্গীতের জন্য দ্রুত লয় এবং ৩) মধ্যগতির সঙ্গীতের জন্য মধ্য লয়। মধ্য লয় বিলম্বিত লয়ের দ্বিগুণ ও দ্রুত লয়ের অর্ধেক গতির হয়ে থাকে। মাত্রা সঙ্গীতের লয় বা গতির দুরত্ব মাপার জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রত্যেকটি মাত্রার মধ্যবর্তী ব্যবধান সমান হয়। কয়েকটি ছন্দোবদ্ধ মাত্রার সমষ্টি দিয়ে তৈরী হয় একটি তাল।[১]

তালের নির্দ্দিষ্ট সময়কালকে অবিচ্ছেদ্দ্য সমান গতিতে অতিক্রান্ত করার নাম লয়। লয় প্রধানত তিন প্রকার-০১. বিলম্বিত লয় ০২. মধ্যে লয় ০৩. দ্রুত লয়। তবে বিশেষজ্ঞ গণ মনে করেন লয় আট প্রকার। এ ছাড়াও মাত্রার ভগ্নাংশ দ্বারা গঠিত বহুপ্রকার লয় হতে পারে যেমন: আড়,কুয়ড়,বিয়াড় ইত্যাদি। তালের মোট সময়টিকে পরিমাপ করার জন্য যে ক্ষুদ্রতম একক ব্যবহার করে লয়কে নির্দ্দিষ্ট করা হয়, এক কথায তাই মাত্রা। তাল হচ্ছে একটি নির্দ্দিষ্ট সময়কে নিদ্দিষ্ট ক্ষুদ্রভাগে ছন্দবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে তাল যন্ত্রে বাদনের মধ্য দিয়ে তার পুনরাবৃত্তি ঘটানো। প্রকৃতিতে আমরা যা কিছু অবলোকন করি তার সবকিছুই ছন্দবদ্ধ ভাবে একটা নিদ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘটে চলেছে অর্থাৎ সবই তালবদ্ধ। একারণে সব কিছুই আমাদের কাছে এত সুন্দর আর মনোরম বলে মনে হয়। আমরা রেলগাড়ীতে চড়লে এর প্রচন্ড শব্দের মাঝেও ঘুমিযে পড়ি কারণ এর চলার গতি ছন্দবদ্ধ ও এর গতি প্রায় সমান থাকে অথচ হঠাৎ ব্রেক কষলেই আমরা চমকে উঠি কারণ তখন চলার ছন্দ পতন ঘটে। তাই তাল হচ্ছে সঙ্গীতের প্রাণ যার বিচ্যুতি আমাদের পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সঙ্গীত জগতে হাজারো তালের জন্ম হয়েছে আবার হারিয়েও গিয়েছে অনেক। তাল যন্ত্রও আছে হাজারো রকমের। এর সবগুলোই যে আমাদের জানতেই হবে তা নয়। প্রাথমিক ভাবে আমরা কিছুতালের সাথে যদি পরিচিত হতে পারি তবে তা আমাদের জ্ঞানের দূয়ার ধীরে ধীরে খুলে দিবে।[২]
সাধারণ বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

তালের নির্দিষ্ট মাত্রা সমষ্টিকে কতকগুলি ছোট বা বড়, সমান বা অসমান বিভাগ এ বিভক্ত করা হয়। এই বিভাগ দুই বা ততোধিক মাত্রার হতে পারে। এর মধ্যে তালের প্রথম বিভাগের প্রথম মাত্রাকে সম্ বলা হয়। সঙ্গীতের সময়ে সম্ কে অন্য মাত্রা থেকে পৃথক করে বোঝানোর জন্য বিশেষ জোর বা ঝোঁক দেওয়া হয়। সম্ কে বোঝানোর জন্য + বা X চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। তালের একটি বিভাগের প্রথম মাত্রার নাম ফাঁক বা খালি। একে ০ চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়। সঙ্গীতের সময় শব্দ না করে হাতের ইঙ্গিতে ফাঁক কে অন্য মাত্রা থেকে পৃথক করে বোঝানো হয়। তালের বিভাগগুলির মধ্যে যে গুলির প্রথম মাত্রায় হাতে তালি দিয়ে শব্দ করে দেখানো হয়, তাদের তালি বা ভরী বলে। ফাঁক ছাড়া আর সব বিভাগের প্রথম মাত্রায় তালি দেওয়া হয়। তালের প্রথম থেকে শেষ মাত্রা পর্যন্ত বাজানোর পর আবার প্রথম থেকে শুরু হলে তাকে আবর্তন বলে। [১]

যে সব তালের পদবিভাগ গুলি সমান মাত্রার দ্বারা গঠিত,তাকে সমপদী তাল বলে। যেমন: দাদরা তালটি ০৬ মাত্রা দ্বারা গঠিত,এর পদবিভাগটি হচ্ছে-- ধা ধি না । না তি না।। আর্থাৎ তিন তিন করে সামান মাত্রা নিয়ে এর পদবিভাজন করা হযেছে। কাহারবা,ত্রিতাল,চৌতাল ইত্যাদিও সমপদী তাল। যে সব তালের পদবিভাগ গুলি অসমান সেই সব তালকে বিসমপদী তাল বলা হয়। যেমন তেওড়া তালটি ০৭ মাত্রার এবং এর পদবিভাজনটি হচ্ছে-- ধা ধি না । ধি না । ধি না ।। অর্থাৎ তিন দুই দুই করে অসমান ভাবে পদ বিভাজন করা হয়েছে। ঝাপতাল, ধামার ইত্যদিও বিসমপদী তাল। সমান সংখ্যক মাত্রা বিশিষ্ট যে কোন বোল বা বাণী পর পর তিনবার বাজিয়ে গদের মুখে আসাকে তিহাই বলে। তেহাই দুই প্রকার। যথা: দমদার তেহাই ও বেদমদার তেহাই। যে তেহাই এর মধ্যবর্তী সময়ে দম নেয়ার অবকাশ থাকে তাকে দমদার তেহাই বলে। যে তেহাই এর মধ্যবর্তী সময়ে দম নেয়ার অবকাশ থাকেনা তাকে বেদমদার তেহাই কলে।

বিভিন্ন প্রকার তাল[সম্পাদনা]
ত্রিতাল[সম্পাদনা]

ত্রিতাল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি বহুল ব্যবহৃত তাল। ত্রিতাল ১৬ মাত্রা বিশিষ্ট সমপদী তাল। এর পদ-সংখ্যা = ৪, ছন্দ-বিভাগ = ৪/৪/৪/৪ । এর তিনটি তালি ও একটি ফাঁক, তাই এর নাম তিনতাল বা ত্রিতাল বা তেতাল বা তেতালা । ত্রিতালের বোল:
+ধা ধিন্ ধিন্ ধা । ৩ধা ধিন্ ধিন্ ধা । ০না তিন্ তিন্ তা । ১তেটে ধিন্ ধিন্ ধা ।। ধা
কাহার্‌বা তাল[সম্পাদনা]

কাহার্‌বা, কাহেরবা, কার্ফা, ইত্যাদি নামে পরিচিত। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে ৪-৪ ছন্দের জন্যে ত্রিতাল ব্যবহার বেশি হলেও লঘু সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ৪-৪ ছন্দের জন্যে কাহারবাই সর্বাধিক ব্যবহৃত। কাহার্‌বা আট মাত্রার একটি সমপদী তাল। চতুর্মাত্রিক (৪-৪) ছন্দ। এর দুটি বিভাগ - একটি তালি ও একটি খালি। কাহারবার বোল:
+ধাˈ গেˈ নাˈ তিˈ । ০নাˈ কˈ ধিˈ নাˈ ।। [১]
+ধাˈ গেˈ তেˈ টেˈ । ০নাˈ কˈ ধিˈ নাˈ ।।
দাদ্‌রা তাল[সম্পাদনা]

এটি একটি ছয় মাত্রার সমপদী তাল। এর ছন্দ ত্রিমাত্রিক। এর দুটি বিভাগ - একটি তালি ও একটি খালি। তালি ১ মাত্রায় ও খালি ৪ মাত্রায়। দাদ্‌রার বোল নিম্নরূপ:
+ধাˈ ধিনˈ নাˈ । ০নাˈ থুনˈ নাˈ ।। [১]
+ধাˈ ধিˈ নাˈ । ০নাˈ তিˈ নাˈ ।।
খেমটা তাল[সম্পাদনা]

দাদ্‌রার ন্যয় 'খেমটা তালটিও ৬ মাত্রায় গঠিত। এতে আছে ১টি তালি বা আঘাত ; ১টি অনাঘাত বা ফাঁক। বোল নিম্নরূপ:
+ধাগে কৎ তা ০ধাগে ধিন ধাধা
তেওরা তাল[সম্পাদনা]

তেওরা তালের আরেক নাম তেওট। এটি সাত মাত্রার বিষমপদী তাল। প্রথম বিভাগটি তিন মাত্রার এবং পরের দুটি প্রতিটি দুই মাত্রার। এতে তিনটি তালি আছে এবং কোন ফাঁক নেই। বিভিন্ন বোলে এটি বাজানো যায়। তবে সচরাচর যে সকর বোলে তবলায় সঙ্গৎ করা হয় সেগুলোর কয়েকটি হলো:
+ধা দেন্ তা । ২তিট কতা । ৩গদি ঘিন ।। [১]
+ধা কৎ তা । ২ধিন ধা। ৩ ত্রেকে ধিন ।।
রূপক তাল[সম্পাদনা]

রূপক তেওরার অনুরূপ একটি তাল। এটিও সাত মাত্রার বিষম্পদী তাল। প্রথম বিভাগটি তিন মাত্রার এবং পরের দুটি প্রতিটি দুই মাত্রার। রূপক তালে ১টি ফাঁক, ২টি আঘাত ; তবে এতে প্রথমেই সম-এর ঘরে ফাঁক। বোল নিম্নরূপ:
০তী তী না । ১ধী না । ২ধী না ।।[১]
০তিন তিন তাক । ১ধিন ধাগে । ২ধিন ধাগে ।।
ঝাঁপতাল[সম্পাদনা]

ঝাঁপতাল এটি ১০ মাত্রায় গঠিত। এর অন্য নাম পাত্‌রা। এতে আছে ৩টি তালি বা আঘাত ; ১টি অনাঘাত বা ফাঁক। বোল নিম্নরূপ:
+ধিন ধা ৩ধিন ধিন ধা0কৎ তা ১ধিন ধিন ধা । ধা বা ধিন ।বা

ধিনা ধিধি না , তিনা ধিধি না
একতাল[সম্পাদনা]

একতাল ১২ মাত্রা বিশিষ্ট একটি সমপদী তাল। এই তালটি তিন প্রকার। যথা: ক)দ্বিমাত্রিক একতাল খ)ত্রিমাত্রিক একতাল গ)চতুর্মাত্রিক একতাল। এছাড়াও বিলম্বিত একতাল বাজানোর সময় এর প্রতিটি মাত্রা চার মাত্রার সমান করে টেনে বাজানো হয়,ফলে তা ৪৮ মাত্রার মত মনে হলেও মূলত: তা দ্বিমাত্রিক একতাল ১২ মাত্রার একটি বিলম্বিত রুপের ভিন্ন প্রকাশ মাত্র।
+ধিন ধিন।০ধাগে তেরেকেটে।২তু না।০কৎ তা।৩ধাগে তেরেকেটে।৪ ধি না।।
+ধিন ধিন না।২তেরেকেটে তু না।০কৎ তু না।৩তেরেকেটে ধি না।।
+ধিন ধিন ধা ধা।২ দেন তা তা ধিন।৩ধাগে তেরেকেটে তুনা কৎতা।।
বিভিন্ন অপ্রচলিত তাল[সম্পাদনা]

এছাড়াও কয়েকটি অপ্রচলিত তাল রয়েছে; এগুলো হলোঃ
তাল খামসা;
পটতাল;
মোহন তাল;
দোবাহার;
ধামার।

তাল খামসা ৮ মাত্রার তাল, যাতে ৫টি তালি এবং ৩টি ফাঁক আছে। পটতাল ৪ মাত্রার, এতে ১ টি তালি এবং ১টি ফাঁক। মোহন তাল ১২ মাত্রায় গঠিত, এতে তালি ৭টি, ফাঁক ৫টি। ১৩ মাত্রার দোবাহার তালে তালি ৯টি এবং ফাঁক ৪টি। ধামার ১৪ মাত্রায় গঠিত, এতে ৩টি তালি এবং ১টি ফাঁক থাকে।
আরও দেখুন[সম্পাদনা]
তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

ঝাঁপ দাও:ক তবলার ব্যাকরণ- প্রথম আবৃত্তি - ডঃ প্রশান্ত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রথম প্রকাশ, চতুর্থ সংস্করণ, জানুয়ারী ১৯৯৬, প্রকাশক - প্রজন্ম, ১৯৭ আন্দুল রোড, হাওড়া
ঝাঁপ দাও↑ http://www.gunjanmusicschool.com/raga/raga-imana-prasange/tatbiya-adhyaya-theory/tala-o-chanda
বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]
তালসমূহের তালিকা - সম্পাদনা


অর্জুন তালঅর্ধ ঝাঁপতালআড় খেমটা তালআড়া চৌতালআড়া ঠেকা তালআদি তালআদ্ধা তালউপরাল তালএকতালকুণ্ডল তালকন্দর্প তালকুম্ভ তালকরালমঞ্চ তালকুলতালকাওয়ালী তালকাশ্মীরী খেমটা তালকাহারবা তালকৈদ ফোরদস্ত তালখয়েরা তালখামশা তালখেমটা তালগজঝম্প তালগণেশ তালচক্র তালচিত্রা তালচৌতালছপকা তালছোট লোফাজগপাল তালজয়মঙ্গল তালঝম্পা তালঝুমরা তালঝুলুম তালঝাতি তালঝাঁপতালটপ্পা তালঠুংরী তালত্রিতালত্রিপুট তালতিলওয়াড়া তালতেওরা তালদাদরা তালদীপচন্দী তালদোবাহার তালধুমালী তালধামার তালনন্দন তালনিঃসারক তালপঞ্চম সওয়ারী তালপটতালপাঞ্জাবী ঠেকা তালপোস্ত তালফোরদস্ত তালব্রহ্মতালব্রহ্মযোগ তালবসন্ত তালবিক্রম তালবিষ্ণুতালবীরপঞ্চ তালভরতঙ্গা তালমত্ততালমণি তালমহেশ তালমোহন তালযৎ তালযতিশেখর তালরুদ্র তালরূপক তালরাশ তাললক্ষ্মী তাললঘুশেখর তাললীলা বিলাস তালশক্তিতালশঙ্কর তালশঙ্খ তালশিখর তালসওয়ারী তালসুরফাঁকতালসরস্বতী তালসাত্তি তালসেতারখানি তালহপ্তা তাল

রাবীন্দ্রিক তাল: উল্টোষষ্ঠী তালএকাদশী তালঝম্পক তালনবতালনবপঞ্চ তালরূপকড়া তালষষ্ঠী তাল

রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক নাচ সম্পর্কে কিছু অদরকারি কথা



রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক নাচ সম্পর্কে কিছু অদরকারি কথা




রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক নাচ সম্পর্কে কিছু অদরকারি কথা



দ্যুতি মুখোপাধ্যায়


“পড়াশোনা তুলনাকমূলক সাহিত্যে, কর্মসূত্রে সাংবাদিক। আরামকেদারা বিপ্লবীও। কথায় কথায় রাজা-উজির মারার অভ্যেস অতএব মজ্জাগত, নিবাস যদিও রাজারহাট। দীর্ঘদিন নাচ শিখেছি, পেশাদার হওয়ার ক্ষুদ্র ইচ্ছা থাকলেও আমল দেওয়া যায়নি নানা কারণে, যার মধ্যে আলস্যটাই প্রধান। অগত্যা নাচ বিষয়ক তর্কে রাজা-উজির মেরে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করে থাকি।” – দ্যুতি

যে কোনও লেখার সামনে গিয়ে খুব অসহায় ভাবে দাঁড়াই আমি। শব্দেরা বরাবরই আমায় বিপদে ফেলতে পছন্দ করে, এবং দীর্ঘদিনের ব্যবহার অভ্যাসে একটা ধারণাই আমার দৃঢ়বদ্ধমূল হয়েছে – ভাষার কাজ যত না প্রকাশ করা তার চেয়ে অনেক বেশি হল আড়াল করা। কাজেই এই আড়ালে উন্মুখ ভাষাকে মাধ্যম করে যখন আমি লিখতে বসি আরেকরকম ভাষারই কথা, তখন কাজটা একটু জটিল হয়ে পড়ে বইকি।


এ ভাষা নাচের। মানে নাচটাই তো ভাষা, তার মধ্যে শরীর ভঙ্গির ভেদ বিচার করে, এক একটা ধরণ নির্ণয় করে আমরা তার নানা রকম নাম দিয়েছি। বাক ও লেখ্য, মানে যাদের আমরা সাধারণত ভাষা বলে বুঝে থাকি, তাদের সঙ্গে নাচের একটা মূলগত তফাত আছে। ভাষার প্রকাশিতব্য সীমাবদ্ধ। আমরা মুখে ধ্বনি তৈরি করি, সে ধ্বনিকে এক একটা সংকেতে চিহ্নিত করি, পরস্পরের মধ্যে সেই সংকেতের গ্রহণযোগ্যতা স্বীকার করি, তার পর গিয়ে তৈরি হয় অর্থ। আর সেই অর্থের গুণেই ধ্বনি শব্দ হয়ে ওঠে। লেখার ক্ষেত্রেও কালির আঁচড়ে কয়েকটা সংকেতকে এভাবে চিহ্নিত করে নিতে হয় আমাদের। কিন্তু এই সব সংকেত বা শব্দ অর্থনিরপেক্ষ ভাবে বক্তা বা রচয়িতার উপস্থিতির দ্যোতক হয়ে উঠতে পারে কি?

নাচ কিন্তু পারে। এক্ষেত্রে আমি মুদ্রার মাধ্যমে কোনও একটি ভাব প্রকাশের কথা বলছি না। সেটাও ওই মুখের বা লেখার ভাষারই সামিল, নর্তক ও দর্শকের মধ্যে একটা বোঝাপড়া দাবি করে তা। কিন্তু না, নাচের মূল ভাষাটি হল উপস্থিতির। যে নর্তক শরীরকে আমরা দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে তার মাধ্যমে ছন্দ ও ভঙ্গিকে ধরে রাখার একটা বিমূর্ত প্রক্রিয়া, যা পূর্বনির্দিষ্ট বোঝাপড়া ছাড়াই পৌঁছে দিতে পারে অর্থ, দ্যোতনা।

ধান ভানতে এত শিবের গীত একটিই উদ্দেশ্যে। যে বিষয়টি নিয়ে আমি এখানে আলোচনার একটা চেষ্টা চালাচ্ছি তা ভারতীয় নাচের একটি বিশেষ ধারা। এবং এমন একটি ধারা যার পত্তন একজন তথাকথিত ভাষাশিল্পীর হাতে। কাজেই ভাষা-সম্পর্কিত সামান্য পিন্ডি চটকানো তার আগ দিয়ে জরুরি হয়ে পড়ে।



রবীন্দ্রনৃত্য নামক নাচের ধারাটি এখন প্রায় মৃত। মানে মৃত তো ঠিক বলা যাবে না। এই তো সেদিন অফিসের বসন্তোৎসবে গিয়ে দেখি সেই পরিচিত দৃশ্য। দুই সাংবাদিক সহকর্মী শাড়ি পরে বাটিকের স্যাশ ঝুলিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছেন, সবাই রবীন্দ্রভাবে গদগদ। ছোটবেলা থেকে এই দৃশ্য কয়েক হাজার বার দেখেছি। আমার নিজের নৃত্যশিক্ষার হাতেখড়িও এই ধারাতেই কি না। তা সেই দীর্ঘ পরিচয়ের সূত্রেই ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ পরিভাষাটি এবং তার অর্থ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ও উপলব্ধি জমা হয়েছিল। এ লেখা সেটাকেই একটা পরিসরে বাঁধার (অক্ষম) প্রয়াস।

শান্তিনিকেতনে পাঠ্যক্রমের সঙ্গে নাচ-গান শিক্ষাকে আবশ্যিক জায়গা দেওয়ার অনেক আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথ নাচ নিয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন, ইউরোপে সামাজিক নৃত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল, এবং সার্বিক ভাবে এই ‘দেহের চলমান শিল্প’টির সম্ভাবনা নিয়েই তিনি আগ্রহী ছিলেন। সে সময় বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষেই নাচ বিষয়টার কৌলীন্য ছিল না। প্রাকৃত জনের বিনোদন এবং অপ্রাকৃত জনের প্রাকৃত আমোদের সামগ্রী হিসেবেই তার পরিচিতি ছিল বেশি। তিরিশের দশকে যে পুনরুজ্জীবন আন্দোলনের হাত ধরে আমাদের ধ্রুপদী নাচগুলি ‘ধ্রুপদী’ ও শাস্ত্রীয় তকমা পাবে এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠবে, তা তখনও যবনিকার ওপারে। অশাস্ত্রীয় আধুনিক নৃত্যের পুরোধাপুরুষ উদয় শঙ্কর তখনও বিদেশে। এমন একটি সন্ধিক্ষণে বিশের দশকে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ একটু একটু করে শুরু করছেন ছাত্রছাত্রীদের নাচের পাঠ দেওয়া। মণিপুর থেকে, রাজস্থান থেকে গুরুদেব ডেকে নিয়ে আসছেন সে সব এলাকার নৃত্যশিল্পীদের, আর তাঁদের কাছ থেকে শেখা নাচ দিয়ে পড়ুয়া-শিক্ষকরা মিলে গড়ে তুলছেন বিশ্বভারতীর নানা উৎসবের নাচ, রবীন্দ্রনাথ রচিত গানের সঙ্গে নাচ। গুরুশিষ্য পরম্পরার থেকে এ নাচের শিক্ষা ও সম্ভাবনা দুইই আলাদা।

কেমন সে নাচ? চিত্রশিল্পের ভাষায় তাকে কোলাজের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে হয়তো। নানা রঙের, নানা ধরনের, লেখা, আঁকা কাগজ কেটে কেটে একসাথে এনে নতুন একটি ছবি তৈরি, যেখানে সেই উপাদানগুলি স্বতন্ত্র স্বাক্ষর বজায় রেখেও হয়ে উঠছে সম্পূর্ণ অন্য কোনও অর্থবাহী। তেমনই রবীন্দ্রনাথ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দিচ্ছেন নানা ধারার নৃত্যে, আর সেগুলি থেকে ভঙ্গিসমূহ নিয়ে গানের আশ্রয়ে গড়ে তুলছেন আলাদা একটি নাচ। ওই বিশিষ্ট নৃত্যধারাগুলির কৌলীন্য ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে তাতে। কিন্তু তৈরি হচ্ছে নতুন অর্থ, যার ভিতরে ওই বিশেষ নাচের (সে মার্গীয় নৃত্য হোক বা লোকনৃত্য) ‘রসিক’ দর্শকের সঙ্গে পূর্বপরিকল্পিত বোঝাপড়াটি নেই। দর্শক চকিত হচ্ছেন, নড়ে বসছেন, যখন মণিপুরনৃপদুহিতা চিত্রাঙ্গদার পদছন্দে মণিপুরির লীলায়িত গতিভঙ্গিমায় এসে মিশছে কথাকলি বা ভরতনাট্যমের দার্ঢ্য।

বলাই বাহুল্য, এত নড়াচড়া, চমকিত হওয়া অনেকেরই পছন্দ হয়নি। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িকে যদি ভয় থেকে থাকে নাচের মতো কৌলীন্যহীন একটি বিষয়কে পাঠ্যক্রমে স্থান দেওয়ায় ভদ্রসমাজের প্রতিক্রিয়ার (সে সময়কার সংবাদপত্রে শান্তিনিকেতনে মণিপুরি নৃত্যশিক্ষার খবর প্রকাশিত হয়েছিল মৃদঙ্গের তালে তালে ব্যায়াম অভ্যাস হিসেবে), পরবর্তী কালে একই রকম নাক সিঁটকেছেন ধ্রুপদী নৃত্যের বিশুদ্ধতাবাদীরা। রবীন্দ্রনাথের জীবতকালে, পরে, এমনকি এখনও পর্যন্ত এই নৃত্যধারা নিয়ে ধ্রুপদী নৃত্যবিদদের মধ্যে চলতি মত, কবিগুরু লেখনীর রসরাজ বটে, তবে স্বীকার করতেই হবে যে নাচ ব্যাপারটা তিনি বিশেষ বোঝেন না! সমালোচনার ধরন থেকেই স্পষ্ট, রবীন্দ্রনাথ যেটা করছিলেন তা ‘ভারতীয় নৃত্যে’র ধারণাটির মূলেই আঘাত করেছিল। নিজে অধিক না বলে শান্তিদেব ঘোষের শরণাপন্ন হওয়াই এ বার বুদ্ধিমানের কাজ, “শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের আগ্রহে যে নৃত্যধারার উদ্ভব হয়েছিল তাকে বলব ভারতীয় আধুনিক নাচ বা মডার্ন ডান্স। ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যগুলি যেমন গাননির্ভর, গুরুদেবের নৃত্য আন্দোলনের মূল ভিত্তিও হল তাই। ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য, লোকনৃত্য এবং বিদেশি নৃত্যকে গুরুদেবের গানের সঙ্গে নৃত্যভঙ্গিতে অভিনয়ের প্রয়োজনে সাজিয়ে নিতে হয়েছে। অর্থাৎ নানা প্রকৃতির নাচের মিশ্রণে এর উদ্ভব, এবং প্রয়োজনমত দেহের সাধারণ অঙ্গভঙ্গিকে স্থান দিতে হয়েছে”।

রবীন্দ্রনৃত্যের বিরুদ্ধ সমালোচনার যে ধরন তা ভারতের আধুনিক নৃত্যশিল্পীদের কাছে ভীষণ পরিচিত। এই তিরে বিদ্ধ হয়েছেন উদয় শঙ্কর, পরবর্তীকালে মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার, রঞ্জাবতী সরকাররা। রঞ্জাবতী তাঁর লেখালিখিতে বারবার স্পষ্ট করতে চেয়েছেন ধ্রুপদী নৃত্যের থেকে তাঁর নাচ কোথায় আলাদা, কিন্তু কেন তা আদ্যন্ত ভারতীয়ই। তাঁর যুক্তিজাল অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথের নাচকে ধরার চেষ্টা করা যাক। প্রতিটি ধ্রুপদী নৃত্যধারারই তো নিজস্ব একটা সামাজিক-রাজনৈতিক-আদর্শগত ইতিহাস আছে। ধ্রুপদী নাচিয়ের শরীরও তৈরি হয় সেভাবেই। উদাহরণ হিসেবে মণিপুরিকে ধরা যাক। প্রাচীন মৈতৈ সমাজ মাতৃতান্ত্রিকতার ঐতিহ্য বহন করত, সে সমাজে মহিলা পুরোহিত শ্রেণি মাইবিদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাঁদের বিশিষ্ট নাচের ধরনে সে মর্যাদার পরিচয় মেলে। সে নাচ বলিষ্ঠ, তার চলন মুক্ত। সাড়ম্বর মুদ্রা ব্যবহার নেই, কিন্তু দেহের চলন আটকায় না কোথাও। ষোড়শ শতকের পর থেকে সে সমাজে ঢুকছে উত্তর ভারতীয় হিন্দুধর্ম। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে আসা রাস নাচে পোশাকের বিশিষ্টতায় মেয়েদের চলন হয়ে আসছে বদ্ধ, চোখ হচ্ছে নিচু, গতি অবরুদ্ধ। এ ভাবেই প্রতিটি ধ্রুপদী নাচিয়ের শরীরই বহন করে তার নৃত্যধারার বিশেষ আদর্শের ছাঁচ।

রবীন্দ্রনাথ এই ছাঁচটাকেই ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। তিনি ধ্রুপদী নৃত্যধারাগুলি থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন ভঙ্গিসমষ্টিকে তুলে এনে তাদের ঢালাই করলেন নিজস্ব বক্তব্যের ছাঁচে। সৃষ্টি করলেন এমন নাচ যেখানে সেই ভঙ্গিসমূহ পাশাপাশি আসতে পারে কোনও আদর্শগত নিয়ম না মেনেই। চিত্রাঙ্গদাকে ধরতে গিয়ে চরিত্রের নিয়মেই অতএব খর্ব হবে বিশুদ্ধতা। তার দেহ মনের টানাপোড়েন শুধু ললিত মণিপুরি বা শুধু ঋজু ভরতনাট্যমে ধরা সম্ভব নয়। নিজের নিজের জগত থেকে বেরিয়ে এই দুই নাচের ভঙ্গিরা পরস্পরের হাত ধরল বলেই তো সৃষ্টি হলেন তিনি যিনি বলতে পারেন ‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী’। তাতে মণিপুরি-ভরতনাট্যম দুই নাচেরই নিজস্ব রসজগত ভেঙ্গে খানখান হবে, ও তৈরি হবেন তৃতীয় এক দর্শক, যিনি এসেছেন চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের রসগ্রহণে, মণিপুরি বা ভরতনাট্যমের নয়।

এ বার প্রশ্ন ওঠে, এই যে এত বড় একটা বিপ্লবের ইঙ্গিত দিলেন রবীন্দ্রনাথ, ভারতীয় নাচের ধারণার একেবারে মূলেই আঘাত হানলেন, তাহলে তাঁর সঙ্গে ‘আধুনিক’ নৃত্য বিষয়টাকে জোড়া হয় না কেন? উত্তরটা রবীন্দ্রনাথের কাছে পাওয়ার উপায় নেই, বরং বলতে পারবেন তাঁর সৃষ্টির স্বঘোষিত অভিভাবকরা।

আমি ছোটবেলা থেকে যে প্রতিষ্ঠানে নাচ শিখেছি সেটির পত্তন রবীন্দ্রনাথের এক ছাত্রের হাতে। উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের নৃত্য-গীত ভাবনার ঐতিহ্য বহন। সেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রনৃত্য শেখানো হয় রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত ‘বিশুদ্ধ’ পদ্ধতি মেনে (অচলায়তন মনে পড়ছে কি?)। এই নৃত্যশিক্ষা পদ্ধতি কী রকম? আমাদের দুটি ধ্রুপদী নৃত্য শেখানো হত, ভরতনাট্যম ও মণিপুরি। ওই প্রতিষ্ঠানে আমার ৯ বছরের শিক্ষাজীবনে কোনও ধ্রুপদী নৃত্য পরিবেশনায় আমি অংশ নিইনি। অংশ নিয়েছি বর্ষামঙ্গলে, নবীনবরণে, নৃত্যনাট্য পরিবেশনায়। ধ্রুপদী নৃত্যের মত সাড়ম্বর পোশাক নয়, কিন্তু আমাদেরও বাঁধা থাকত ইউনিফর্ম।. সাধারণ কুঁচি দিয়ে পরা শাড়ি, কাঁধে ও কোমরে উত্তরীয় (বাটিকের হলেই ভাল), টানা টানা চোখ, বাধ্যতামূলক রুপোলি গহনা। একটু বড় হয়ে আমরা যখন একক নাচের সুযোগ পেয়েছি, তখন আমাদের উতসাহ দেওয়া হয়েছে এই দুই নাচের ভঙ্গিভাণ্ডার থেকে ধার করে নিজস্ব নাচ গড়ে তুলতে। ইচ্ছেমতো বেছে নিতে বলা হয়েছে নদীর চলন, ঝড়ের গতি, হৃদয়বেদনার মুদ্রা। এত তো স্বাধীনতা। তা হলেও একটু বড় হওয়ার পর থেকেই, মানে নাচ ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবার মতো বড় হওয়ার পর থেকেই সংশয় কেন চেপে বসল?

সংশয় বহুবিধ। প্রথমত, এই স্বাধীনতারও একটা সীমা ছিল। পরম্পরা রক্ষকদের মত ছিল, রবীন্দ্রনাথের নাচ মণিপুরি আশ্রয়ী। কাজেই চলন কাঠামো হতে হবে অনুরূপ। ব্যক্তিগত ভাবে মণিপুরি নৃত্যধারা পছন্দ করার কারণে এই সীমাবদ্ধতায় তখন অবশ্য আমার অসুবিধা হয়নি (বা হয়তো এই আদর্শগত শিক্ষা থেকেই মণিপুরি নিয়ে অতিরিক্ত ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল, কে জানে!)। দ্বিতীয় সংশয়টা অনেক গভীর, ও সার্বজনীন। আমাদের নাচের পরীক্ষাগুলি দিতে হত ধ্রুপদী নৃত্যধারাতে। বাইরে থেকে সেই নৃত্যধারার এক এক জন গুরু এসে পরীক্ষা নিতেন। আমাদের অধিকাংশ নৃত্যশিক্ষিকাও ছিলেন মূলত ধ্রুপদী নৃত্যধারাতেই শিক্ষিত। এই জগতটা আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রায়ই নাক সিঁটকাত। ‘তোমাদের টেকনিক বড্ড ভুলভাল’, কতবার শুনেছি। আর আমরাও তো অবাক হয়ে দেখতাম, ভরতনাট্যম দিদিমণির পিঠ কেমন যেন বেশি সোজা থাকে সব সময়েই, মুদ্রাগুলো আরও কত কাটা কাটা। আমার হাত-পা এলিয়ে যায়, অভিযোগ তাঁর। আবার মণিপুরি দিদিমণির মতে, আমি নাকি বড্ডই কাঠ কাঠ, হাত-পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে নাচি। লাও ঠ্যালা!

এই ঠ্যালা সামলাতে যারা মোটামুটি নাচ নিয়ে সিরিয়াস তারা ডিপ্লোমা পাওয়া মাত্রই গিয়ে নাম লেখাতো কোনও বিশুদ্ধ ধ্রুপদী নৃত্য প্রতিষ্ঠানে, শাস্ত্রীয় ছকে বেঁধে নিত জীবন। বাকিদের ক্ষেত্রে বিবাহ বাজারের সিভিতে একটি অতিরিক্ত গুণ যোগ করা ছাড়া রবীন্দ্রনৃত্য আর কোনও কাজে লেগেছে বলে আমি দেখিনি।

মুশকিলটা হল, রবীন্দ্র সংস্কৃতির যাঁরা ধ্বজাধারী, তাঁরাও বোধহয় এই নৃত্যধারাটির জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু চাননি। রবীন্দ্রনৃত্য মানে এইই। সেই কবে বিশ শতকের শুরুতে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ও তাঁর সহযোগীরা যে যে নাচ থেকে উপাদান আহরণ করে সেগুলি যে যে ভাবে মিশিয়ে গানের সঙ্গতে একটা নতুন প্রকাশমাধ্যম তৈরি করেছিলেন, সেই কাঠামোটিকেই ছাঁচে খোদাই করে বছরের পর বছর ছাপ্পা মেরে যাওয়া। সময়ের নিয়মে যেমন তা তরলীকৃত হয়েছে, তেমনই অন্য দিকে তার অর্থ সম্ভাবনারও বিস্তার, পরিবর্ধন, পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু নাচে নতুন রক্ত ঢোকেনি, আর সেটা করা হয়েছে সচেতনভাবেই। শান্তিদেব ঘোষ তাঁর বহুবিধ সমস্যা-সংস্কার সত্ত্বেও একটা জিনিস ঠিকই ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনৃত্যকে কোনও তথাকথিত school of dance বলাটা ভুল হবে, সেটা বরং একটা নতুন ভাবনার, ভাবধারার দ্যোতক। পরবর্তীকালের রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা কিন্তু ঠিক এই ভুলটাই করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তো নাচকে সামাজিক জীবনের অঙ্গ করে তুলতেও চেয়েছিলেন। সেখান থেকেই আসছে নৃত্যকে শরীরের স্বাভাবিক সহজাত ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার চিন্তা। সেখান থেকেই বসন্তোৎসবের প্রভাতফেরীতে অনায়াস জায়গা করে নিচ্ছে পশ্চিম ভারতের গোষ্ঠীনৃত্য ডান্ডিয়া। এই সব সামাজিক নৃত্যের সুখস্মৃতি পাঠভবনের পড়ুয়ারা সারাজীবন বহন করবেন, তা তাঁদের ব্যক্তিগত পাওয়া। নাচ নামক শিল্পমাধ্যমটির তাতে লাভের লাভ কিছু হয়নি।

অথচ হওয়ার তো কথা ছিল। রবীন্দ্রনৃত্যের ধারণার মূলেই আছে স্বাধীন চলনের শিক্ষা। সমসাময়িক দিয়ে নাচের আঙ্গিক ও উপাদান নির্ধারণ করার শিক্ষা। তা সেই ছকভাঙ্গার নাচকে যখন ছকে ঢালাই করা হল সেখানে ফাঁকির ভাগটাই বসল গেঁড়ে। এই অসুখটা দেখেছি আমার ঐ প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকার মধ্যে। একটা নতুন নাচ তৈরির সময় কখনই বিশেষ খাটতে দেখিনি তাঁদের। ‘গত ফাংশনে এই গানটায় কী হয়েছিল মনে নেই? ব্যস, ওটাই করে দে’। স্টেজে মেরে দেওয়ার আত্মবিশ্বাস আমার সম্ভবত তৈরি হয়েছে এখান থেকেই। এই ৮ ঘণ্টার শিফটে অফিস ঠেলা নিতান্ত স্থূলকায় আমাকেও যদি কোনও একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে বলা হয় এক্ষুনি নাচ, আমি ঠিক নেচে দেব। এবং হাততালিও পাব। আমার দর্শক, রবীন্দ্রনৃত্যের দর্শক তো ওই হাত ঘুরুঘুরু সহজ ললিত ছকটার বাইরে আমার থেকে কিছু প্রত্যাশাই করেন না।

এ বার আমার সেই শিক্ষাগুরুদের নৃত্যপ্রতিভা নিয়ে আমি সংশয় প্রকাশ করছি না। তাঁরা আমার থেকে অনেক বেশি করে নাচের মধ্যে আছেন। তাঁদের নিজেদের নাচের স্কুল আছে, ধ্রুপদী নাচের স্কুল। সেখানে তাঁরা প্রশ্নাতীত ভাবে একনিষ্ঠ। কিন্তু আমাদের সেই প্রতিষ্ঠানে তাঁরা প্রায় কোনও শ্রমই ব্যয় করতেন না। ‘ও তো সহজ নাচ’। সমস্যা এটাই। রবীন্দ্রনৃত্য নাচ নয়, ‘আসল’ নাচ হল ধ্রুপদীই। এই ছেলেখেলা সিন্ড্রোম থেকে যদি খোদ শিল্পীরাই না বেরোতে পারেন তাহলে সে নৃত্যধারাকে বাঁচিয়ে রাখে কার সাধ্যি। হয়েছেও তাই। অফিসের বসন্তোৎসবে বা পাড়ার ফাংশনে সহকর্মী বা কাকু-কাকিমার স্নেহবর্ধন ছাড়া এই মুহূর্তে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে রবীন্দ্রনৃত্যের আর কোনও ভূমিকা নেই। ভাসানের নাচ এর থেকে অনেক বেশি নৃত্যগন্ধী একটা বিষয়।

অথচ যদি এই পথ পরিক্রমাটাই অন্য রকম হত? কী হতে পারত তার একটা উদাহরণ আমরা পেয়েছি মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার ও তাঁর হাতে গড়া ডান্সার্স গিল্ডের এক সময়ের পরীক্ষা-নিরিক্ষায়। মঞ্জুশ্রীর পেশাদার মঞ্চে নৃত্য পরিবেশনা শুরু রবীন্দ্রনাথের গান, নৃত্যনাট্যের হাত ধরে। কিন্তু এককালে গণনাট্য সঙ্ঘে যুক্ত, বিশ্বভারতীর অন্যতম চক্ষুশূল গায়ক দেবব্রত বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ মঞ্জুশ্রীর নৃত্যধারণা তাঁর আদর্শগত অবস্থান থেকেই রবীন্দ্র-প্রাতিষ্ঠানিকতার বিপরীতে হেঁটেছে। রবীন্দ্রনাথকে মঞ্জুশ্রী দেখেছেন তাঁর ধ্রুপদী ছক ভেঙ্গে দেওয়ার বৈপ্লবিক সম্ভাবনা থেকে। বিশ্বভারতীর মতো রবীন্দ্রসৃষ্ট ফর্মটিকে অন্ধ অনুসরণ না করে তার আদর্শটিকে মঞ্জুশ্রী গ্রহণ করলেন। ‘তোমারি মাটির কন্যা’, ‘তাসের দেশ’-এর মতো রবীন্দ্র-আশ্রয়ী সৃষ্টির পাশাপাশি সমান তালে মঞ্জুশ্রী ও পরবর্তীকালে তাঁর কন্যা ভারতীয় আধুনিক নৃত্যের দিকপাল শিল্পী রঞ্জাবতী রচনা করে গিয়েছেন ‘অরণ্য অমৃতা’, ‘গঙ্গোত্রী’র মতো স্বাধীন পরিবেশনা। রবীন্দ্রনাথের থেকে ধ্রুপদী আশ্রয়ী হয়েও ধ্রুপদী ছক না মানার যে ধারাটি তাঁরা নিয়েছিলেন, এর সবকটিতেই কিন্তু তার প্রয়োগ ঘটেছে।

আর তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা গভীর চিন্তা-ভাবনা করেছেন এই নৃত্যধারার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা কী হতে পারে তা নিয়ে। বিশেষত রঞ্জাবতী তাঁর নাচ সংক্রান্ত লেখালিখিতে একাধিক বার এই পদ্ধতিগত প্রশ্নটি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। মঞ্জুশ্রী-রঞ্জাবতী নৃত্যজীবনের দীর্ঘ অংশ ধরে ভেবেছেন, ধ্রুপদী পরম্পরার বাইরে গিয়ে কী ভাবে একজন নাচিয়ের শরীরকে নাচের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা যায়।

এই ভাবনাটার প্রয়োজন ছিল। আধুনিক নৃত্যধারণার মূল কথাই হল নিয়ম নির্ভরের বিপ্রতীপে ভাবনা নির্ভর নাচ। রঞ্জাবতী যেমন লিখছেন তাঁর লক্ষ্যের কথা, শরীরকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যে আমি কতটা পারব ভেবে নাচব না, আমি কী নাচব ভেবে নিয়ে শরীরকে সেই মতো পারাব। এখন, যে কোনও নাচিয়ের কাছেই এই সমস্যাটা খুব স্পষ্ট। শারীরিক সক্ষমতা ও প্রকাশের ইচ্ছার মধ্যে টানাপোড়েন এক অনন্ত, ঘটমান প্রক্রিয়া। আর এর বাস্তব অসুবিধাগুলি মারাত্মক। শারীরিক আঘাত, পঙ্গুত্ব থেকে মানসিক অস্থিরতা – সবটাই চলে আসতে পারে। ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী এই টানাপোড়েনের বাইরে নন মোটেই। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে সুবিধা (যদি সুবিধা বলা যায়) একটাই। প্রতিটি ধ্রুপদী নৃত্যের প্রকাশভঙ্গীর সম্ভাবনা সীমাবদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ যে নৃত্য আদর্শের সন্ধান দিয়েছিলেন, তার ভঙ্গি-সম্ভাবনা অসীম। মঞ্জুশ্রী এই অসীমত্বের বিপদগুলি বুঝেছিলেন বলেই প্রশিক্ষণের উপর এত জোর দিয়েছেন। তাঁদের নবনৃত্য তৈরিই হয়েছে নাচিয়ের শরীরের ভারসাম্য নষ্ট না করে তার সক্ষমতা চুড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য থেকে (এর গুণবিচারে যাওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই, বিস্তারিত ধারণা পেতে ঐশিকা চক্রবর্তী সম্পাদিত Ranjabati: A Dancer and Her World বইটি পড়ে দেখা যেতে পারে)। রবীন্দ্রনাথের মত তাঁদের ধারাও ধ্রুপদী নৃত্যকে রাখছে হাতের কাছে, তার থেকে আহরণ করছে প্রাণবস্তু। কিন্তু রবীন্দ্রনৃত্যের মত সেই আহরণের মাপকাঠি ‘শান্তিনিকেতনে কি হইয়াছিল’ থাকছে না। মাপকাঠি হচ্ছে নাচকে, নাচিয়ের শরীরকে স্বতন্ত্র মাধ্যম করে তোলার প্রয়োজনটুকু।

লেখার একদম প্রথমে যে বিষয়টা তুলেছিলাম,সেই উপস্থিতির প্রশ্নে এবার ফেরত যাব। রবীন্দ্রনাথের নাচ হয়ে উঠেছিল তাঁর কথাশিল্প প্রকাশেরই একটি মাধ্যম, ধ্রুপদী ছক ভেঙ্গেছিল প্রকাশিতব্যের অভিনবত্বের তাগিদে। মঞ্জুশ্রী-রঞ্জাবতীরা সেই ছকভাঙ্গার ধারণাটিকেই আর একটু বিস্তৃত করে দিয়ে তার প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন নাচিয়ের উপস্থিতিকে প্রকাশের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, আমি যখন নাচছি তখন আমার বিদ্যেবুদ্ধি, আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি – মোট কথা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ছকে আমার অবস্থানটা দিয়েই বেছে নিচ্ছি আমার হস্তমুদ্রা,আমার গতি, আমার চোখের চলন, আমার ওঠাবসার পরিমাপ। আর সেটা আমি নিচ্ছি ধ্রুপদী নৃত্যধারার যুগসঞ্চিত ভাণ্ডার থেকেও।

এবার পাঠক বলবেন এটাও কি একটা আদর্শ পরিস্থিতিই হয়ে গেল না, ঠিক যেটার ফাঁদে পড়ার দায়ে আমি অভিযুক্ত করেছি আমার পুরনো প্রতিষ্ঠানটিকে? একদমই তাই। সেই কারণেই হয়তো ১৯৯৯ সালে রঞ্জাবতীর আত্মহত্যা ও ঠিক পরের বছর রোগভোগে ভগ্নহৃদয় মঞ্জুশ্রীর মৃত্যু থমকে দিতে পারে নবনৃত্য আন্দোলনকেও। ডান্সার্স গিল্ড এখনও আছে। ছোটবেলায় সেখানকার ছাত্রী এক দিদির সঙ্গে সঙ্গে লেপ্টে থেকে খানিক সুযোগ হয়েছিল নবনৃত্য চেখে দেখার। তখন বেশ নতুন জগতের স্বাদ পেয়েছিলাম। কিন্তু বছর কয়েক আগে তাদের অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে হতাশ হয়েছি। মঞ্জুশ্রীর নাচ আমি দেখিনি, রঞ্জাবতীর ‘অরণ্য অমৃতা’ দেখেছি দূরদর্শনে। সেটা ১৯৮৯ সালের নৃত্যনির্মিতি। ২০১০-১১য় ডান্সার্স গিল্ড তার চেয়ে খুব বেশি এগোয়নি। পোশাক ভাবনা থেকে শুরু করে সমবেত নৃত্যের formation, ৮০-৯০-এর দশকেই পড়ে আছে। সে নাচের ভাবনার খোরাক দেওয়া, দর্শককে নাড়া দেওয়া তো দূর, নিদেন পক্ষে চমকে দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও যেন নেই।

এটাই হয়েছে বারবার, সম্ভবত এটাই হওয়ার। পরীক্ষা-নিরিক্ষায় ভাঁটা পড়লেই প্রতিষ্ঠান অচলায়তন হয়ে জাঁকিয়ে বসবে। রবীন্দ্রনাথ তো আর তাঁর প্রবর্তিত নাচকে রবীন্দ্রনৃত্য বলেননি, তাঁকে যাঁরা ঠাকুর বানিয়েছেন তাঁরাই পরিভাষাতেও বেঁধেছেন। কিন্তু মঞ্জুশ্রী-রঞ্জাবতীরা তো চেষ্টা করেছিলেন নৃত্যরত শরীরের সম্ভাবনাগুলিকেই খুলে দেওয়ার, এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার যা নাচিয়েকে নিজের প্রকাশ নিজেই তৈরি করার সুযোগ করে দেবে। রঞ্জাবতীর নিজের ভাষায় এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করা যেখানে “The body of the dancer always has its own presence and being, regardless of the form explored.” তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানও কিন্তু ভুলে গেছে সে কথা। আসলে প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে হয়তো এটাই হবে। মাস মাইনে দিয়ে বছর বছর ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের নিয়মে বেঁধে নাচ শেখাতে হলে হয়তো ভাবধারা নিয়ে চিন্তার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। রঞ্জাবতীর আত্মহত্যার পিছনেও এমন একটা টানাপোড়েনের দিকেই ইঙ্গিত করেন গবেষকরা। মায়ের দুরারোগ্য ব্যাধি রঞ্জাবতীকে বাধ্য করেছিল ডান্সার্স গিল্ড পরিচালনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে। কিন্তু ৩৬ বছর বয়সে নিজের সবচেয়ে সৃজনশীল সময়টিতে প্রতিষ্ঠান চালানোর গুরুদায়িত্ব বহন করতে সম্ভবত যথেষ্ট প্রস্তুত ছিলেন না রঞ্জাবতী।

প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরেই কি তবে খুঁজতে হবে পথ? এ ক্ষেত্রেও রাস্তা দেখিয়েছেন সেই বৃদ্ধই। শান্তিনিকেতনে কর্মশালা পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সময় ধরে এক এক জন গুরুর কাছে নাচ শিখেছেন ছাত্রছাত্রীরা। পরবর্তীকালে পাঠ্যক্রমের চাপে বন্ধ হয়েছে এই নতুন নতুন জানাশোনার আসর, নাচের সজীবতাও গেছে। সমসাময়িক নাচের জন্য সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরের চেয়ে অনেক বেশি উপযোগী কর্মশালা ও artist collaboration পদ্ধতিই। সারা বিশ্ব জুড়েই এ ধরনের পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা ক্রমশ বাড়ছে। এ পোড়া বঙ্গদেশে অবশ্য পথিকৃতকে পুজো করা হয়, তাঁর ভাবনা নিয়ে ভাবার লোক বিশেষ নেই। ফলে বছর বছর খারাপ থেকে খারাপতর ‘সমসাময়িক’ নৃত্য পরিবেশনা হয়েই যাবে। এবং ধ্রুপদী নৃত্যধারাগুলি নিজেদের সীমাবদ্ধতা ও স্বাতন্ত্রের মধ্যে তফাত করতে না পেরে ‘সমসাময়িক’ হয়ে ওঠার চেষ্টায় সেই তালিকা বৃদ্ধি করবে। উদাহরণ দিই? এই সেদিন দেখলাম কত্থক নৃত্যশিল্পী অসীমবন্ধু ঘোষ ও মণিপুরি নৃত্যশিল্পী বিম্বাবতী দেবী যৌথ প্রযোজনা করছেন ‘আঁধার ঘরের রাজা’, রবীন্দ্রনাথের শাপমোচনের অনুসরণে। জমকালো মঞ্চ, চোখধাঁধানো আলো, সুচারু পোশাক ভাবনা সব ঠিক আছে। নাচটাই তো মিশ খেল না। রাজা চরিত্রে অসীমবন্ধু ও সুদর্শনা চরিত্রে বিম্বাবতী নিজের নিজের ধারায় নেচে গেলেন। অনেকটা সেই কেন্দ্রীয় সরকারি অনুষ্ঠানগুলোয় সব ধরনের নাচ একসঙ্গে স্টেজে গুঁজে দেওয়ার ধ্রুপদী ফিউশনের মতো। আর একবার বিশুদ্ধ ভরতনাট্যমে চিত্রাঙ্গদা অভিনয় দেখতে গিয়েছিলাম। আধ ঘণ্টা পর পালিয়ে বেঁচেছি।

তা হলে খাড়াইল কী? কিছুই না বলতে গেলে। নাচের মূল ভাষা যে উপস্থিতিরই, সেই ধারণা ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যে নেই। আর বিশ্বায়িত বিশ্বে ভারতীয়-অভারতীয় তর্কটাও অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যায়িত। সমসাময়িক নৃত্য আলাদা হয়ে যায় নাচিয়ের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করেই। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যভাবনায় এ স্বীকৃতির সম্ভাবনা ছিল। তাঁর প্রতিষ্ঠান তা দেয়নি। তবে একটা জিনিস দিয়েছে। সংশয়। রবীন্দ্রনৃত্য ও নবনৃত্য এই দুই ধারার সঙ্গেই খুচরো খুচরো পরিচয় আমার মধ্যে এই সংশয়কে পুরে দিয়েছিল বিরাট ভাবে। অনেক সুযোগ হারিয়ে এবং আলস্যের মাশুল দিয়ে দিয়ে আজ বুঝতে পারি, এই সংশয়কে ধারণ করতে পারা বা না পারাই একজন সমসাময়িক নৃত্যশিল্পীকে ভাঙ্গে-গড়ে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি যতই অপর্যাপ্ত হোক না কেন, নিহিত আদর্শটিকে তো কোথাও না কোথাও ধারণ করেই আছে। বিশুদ্ধ রবীন্দ্রনৃত্য ঘরানার শিল্পী পূর্ণিমা ঘোষের অসামান্য প্রাণবন্ত নাচ এখনও চোখে ভাসে আমার। সেই ছাপ্পা মারার কারখানাতেই তিনিও তো ছিলেন।

রবীন্দ্রনৃত্য থেকে প্রাপ্তি বোধহয় এই সংশয়টুকুই। ভাবতে ভাল লাগবে, আমার সঙ্গে যাঁরা পাশ দিয়ে বেরিয়ে নাচকেই ধ্যানজ্ঞান করেছিলেন, সেই প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর ভিতরে এই সংশয় জন্মেছে। তাঁরা যদি কোন ধারায় নাচছি তা নিয়ে না ভেবে নাচছি এটাই ভাবার শিক্ষাটুকু গ্রহণ করতে পারেন রবীন্দ্রনাথের থেকে, তাহলে হয়তো আশার কথা আছে এখনও।

তথ্য ঋণ স্বীকারঃ

গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য, শান্তিদেব ঘোষ

Ranjabati: A Dancer and Her World, Ed. Aishika Chakraborty

সংগীতের ব্যকরন

সংগীতের ব্যকরন

সংগীতের ব্যকরন

বাংলা ,ইংরেজি ব্যকরনের মত সংগীতের ও ব্যকরন রয়েছে ।সংগীতের ব্যকরন কে উপপত্তিক বলা হয় । সঙ্গীতে অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয় এই শব্দ গুলোকে পরিভাষা বলা হয় । এই পরিভাষা না বুঝলে শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয় । ভালো গান গায়তে পারা ও সংগীত সম্পর্কে ভালো ধারনা রাখা এক নয় । সংগীত সম্পর্কে ভাল ধারনা রাখতে ও সুরের গভীরে প্রবেশ করে সংগীত সম্পর্কে ভালো ধারনা রাখতে হলে অবশ্যয় । পরিভাষা শব্দ প্রকরন ও ব্যকারনিক জ্ঞান থাকতে হবে । সংগীত জগতের পরিধী ব্যপক তবু সংক্ষেপে প্রশ্ন উত্তর এর মাধ্যমে বিষয় গুলো সহজে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে । হয়ত বা অনেক প্রশ্নের উত্তর এখানে সং যোজন করা সম্ভব হবেনা । তাই আপনাদের জানা প্রশ্ন উত্তর আমাদের সাথে সেয়ার করতে পারেন । এবং সংগীত বিষয়ক যে কোন প্রশ্ন করতে পারেন সাহায্য চাই ক্যটাগড়িতে । আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করব উত্তর দেবার । নিম্নে আমরা সংগীত বিষয়ক প্রয়জনীয় প্রশ্ন উত্তর দিয়ে দিলাম ।আশা করি আগ্রহী ও নবীন শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবেন । প্রশ্ন ১ . সংগীত কাকে বলে ? কত প্রকার কি কি ? এক কথায় গীত , বাদ্য ও নৃত্যর সমষ্টিকে শাস্ত্রমতে সংগীত বলে । কিন্তু গীত , বাদ্য ও নৃত্য আলাদা আলাদা এক একটি কলা বা বিদ্যা । সংগীত সাধারণত দুই প্রকার । ১. উচ্চাঙ্গ বা মার্গ সংগীত । (রাগ , খেয়াল , ধুন ইত্যাদি সংগীত কে উচ্চাঙ্গ বা মার্গ সঙ্গীত বলে । ২. লঘু সংগীত বা দেশীও সংগীত হালকা অঙ্গের গান আধুনিক ,পল্লিগীতি ভাটিয়ালী ইত্যাদি গান গুলো লঘু সংগীতের নামে পরিচিত । দৃষ্টি আকর্ষণ –ব্যান্ড , হিপহপ এই ধরনের গান গুলো আমাদের দেশীও না হলেও লঘু সংগীতের অন্তর্ভুক্ত । আমাদের দেয়া তথ্যে কারো দ্বিমত থাকলে উপযুক্ত প্রমান সহ আমাদের সাথে সেয়ার করুন । অবশ্যয় আপনার মতামতের মূল্যায়ন করব । প্রশ্ন ২. সংগীত শাস্ত্র কাকে বলে ? কত প্রকার কি কি ? যে সকল গ্রন্থ পড়ে সংগীতের বিষয় সমুহে জ্ঞান লাভ করা যায় । সে সকল গ্রন্থ গুলোকে সঙ্গীত শাস্ত্র বলে । সঙ্গীত শাস্ত্র সাধারণত তিন প্রকারের হয়ে থাকে । ১. গীত ধায্য (উচ্চাঙ্গ , লঘু সঙ্গীত সম্পর্কিত গ্রন্থ । ) ২. বাদ্য ধায্য ( বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কিত গ্রন্থ ) ৩. নিত্য ধায্য ( নিত্য সম্পর্কিত গ্রন্থ ) প্রশ্ন ৩. গীত কাকে বলে ? বাদ্য যন্ত্র বিহীন শুধু কণ্ঠের সাহায্যে শ্রুতি মধুর ভাবে পরিবেশন করা কে গীত বলে । গীত নানা প্রকারের হয়ে থাকে ধ্রুপদ , খেয়াল , ঠুমরী , ভাটিয়ালী ইত্যাদি । আমাদের সংস্কৃতি জুড়ে বিয়ে সহ নানা অনুষ্ঠানে এক ধরনের গীতের প্রচলন ছিল । যা আজ বিলুপ্তির পথে .কিন্তু সে সকল কৃষ্টি কালচার গুলো আমাদের ঐতিহ্য । প্রশ্ন ৪. অচল স্বর কাকে বলে ? সপ্তকের সা ও পা কে অচল স্বর বলে । কারন এই দুটি স্বরের কোন কোমল বা কড়ি স্বর নেই । মা এর কোমল স্বর (ক্ষ) তিব্র বা কড়ি অথবা মধ্যম নামে পরিচিত । সপ্তক কাকে বলে ? কত প্রকার কি কি ? সাতটি স্বর সা রে গা মা পা ধা নি এই সাতটি স্বরের একত্রিত নাম হলো সপ্তক ।তবে শুদ্ধ স্বর ৭ টি ও কোমল স্বর ৫ টি মোট ১২ টি স্বরের সমষ্টি হলো সপ্তক । কোমল স্বর গুলো শুদ্ধ স্বরের নাম নেই কিন্তু অবস্থান নেই না । সপ্তক তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে । ১। উদার (অনেকে মন্ত্র বলে ) ২ মুদারা (অনেকে মধ্যম বলে ) ৩। তারা উদার , মুদারা ,তারা চেনার সহজ উপাই হচ্ছে । সি বা সা হতে বাম দিকের স্বর গুলোই উদার স্বর ।স্বরলিপি লেখার ক্ষেত্রে উদার স্বর গুলোর নিচে একটি হসন্ত ( ্ ) যুক্ত থাকে যেমন স্ র্ মুদার – আপনার সা হতে নি পর্যন্ত মুদার স্বর । অনেক গুণীজন সহজে বোঝানোর জন্য বলে থাকে আপনার সা হতে সা পর্যন্ত মুদার স্বর ।মুদারার স্বর গুলোতে কোন চিহ্ন থাকেনা । উপরের র্স থেকে ডানের স্বর গুলো হলে তারা । তারা স্বর গুলোতে একটি রেফ ( র্স ) চিহ্ন থাকে । লক্ষনীয় ভারতের কোন কোন প্রদেশে রেফ ও হসন্ত চিহ্নের পরিবর্তে ০ চিহ্ন ব্যবহার করে থাকে । সপ্তকের শাস্ত্রীয় নাম ও রূপ ।শুদ্ধ ও কোমল স্বরের পরিচয় । শুদ্ধ স্বর সা এর শাস্ত্রীয় নাম হলো ষড়জ বা স্বরোজ । এর কোন কোমল রূপ হয়না । শুদ্ধ স্বর র এর শাস্ত্রীয় নাম হলো রেখাব বা ঋষভ । এর কোমল রূপ ঋ । শুদ্ধ স্বর গ এর শাস্ত্রীয় নাম হলো গান্ধার । এর কোমল রূপ জ্ঞ । শুদ্ধ স্বর ম এর শাস্ত্রীয় নাম হলো তিব্র বা মধ্যম । এর কোমল (কড়ি) রূপ হ্ম । শুদ্ধ স্বর প এর শাস্ত্রীয় নাম হলো পঞ্চম । এর কোমল রূপ নেই । শুদ্ধ স্বর ধ এর শাস্ত্রীয় নাম হলো ধৈবত । এর কোমল রূপ দ । শুদ্ধ স্বর ন এর শাস্ত্রীয় নাম হলো নিষাদ বা নিখাদ । এর কোমল রূপ ণ । তাহলে বোঝা গেল , শুদ্ধ স্বর ৭ টি ও কোমল স্বর ৫ টি মোট ১২ টি স্বরের সমষ্টি হলো সপ্তক । কোমল স্বর গুলো শুদ্ধ স্বরের নাম গ্রহন করে কিন্তু অবস্থান ও রূপ গ্রহন করেনা । এবং সপ্তকের সা ও পা কে অচল স্বর বলে । কারন এই দুটি স্বরের কোন কোমল বা কড়ি স্বর নেই । সংগীতের স্বর কয়টি ও কি কি ? সংগীতের শুদ্ধ স্বর ৭ টি ও কোমল স্বর ৫ টি মোট ১২ টি স্বর যথা- সা রে (ঋ ) গা (জ্ঞ ) মা (হ্ম )পা ধা (দ) নি (ণ) তবে সাধারনভাবে আমরা সংগীত সাতটি স্বর বলে থাকি । আরোহী ও অবরোহী কাকে বলে ? ক্রমাশানুযায়ী স হতে নি পর্যন্ত উপর দিকে যাওয়া কে আরোহী বলে । এবং উপর থেকে নিচে নেমে আসা কে অবরোহী বলে । হারমোনিয়ামের অঞ্চল কাকে বলে ? ১। উদার (অনেকে মন্ত্র বলে ) ২ । মুদারা (অনেকে মধ্যম বলে ) ৩। তারা উদার , মুদারা ,তারা চেনার সহজ উপাই হচ্ছে । সি বা সা হতে বাম দিকের স্বর গুলোই উদার স্বর ।স্বরলিপি লেখার ক্ষেত্রে উদার স্বর গুলোর নিচে একটি হসন্ত ( ্ ) যুক্ত থাকে যেমন স্ র্ মুদার – আপনার সা হতে নি পর্যন্ত মুদার স্বর । অনেক গুণীজন সহজে বোঝানোর জন্য বলে থাকে আপনার সা হতে সা পর্যন্ত মুদার স্বর ।মুদারার স্বর গুলোতে কোন চিহ্ন থাকেনা । উপরের র্স থেকে ডানের স্বর গুলো হলে তারা । তারা স্বর গুলোতে একটি রেফ ( র্স ) চিহ্ন থাকে । লক্ষনীয় ভারতের কোন কোন প্রদেশে রেফ ও হসন্ত চিহ্নের পরিবর্তে ০ চিহ্ন ব্যবহার করে থাকে । এই উদার মুদারা , তারা এর সমষ্টি হল হারমোনিয়ামের অঞ্চল । সুর কাকে বলে ? স্বরের সঙ্গে আ-কার , ই-কার যুক্ত করে গাওয়াকে সুর বলে । সপ্তকের ক্ষেত্রে সা এর শাস্ত্রীয় নাম হলো ষড়জ বা স্বরোজ এই সা কেউ সুর বলে । সুর সম্পর্কে মজার ঘটনা । আমাদের রাজশাহী চাঁপাই নবাবগঞ্জ এ সা কে সুর বলাটা হাশ্যকর মনে হলেও অন্যন্য জেলাতে সা কে সুর বলা হয় । এ প্রসঙ্গে একটি মজার কথা মানিকগঞ্জের ফারুক ভাই আমাকে সুর ধরতে বলল । আমি তো গান ধরার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম । কিন্তু উনি যখন তবলায় দুটি টোকা মাড়লেন বুঝে নিলাম উনি তারা সা ধরতে বললেন ।কিন্তু আমার মস্তিকের সবুজ সিগন্যাল পেতে দুই তিন সেকেন্ড দেড়ি হওয়াতে উনি ব্যাপারটি বুঝে নিলেন । দুজনে হাসতে লাগলাম । উনি বললেন আপনাদের অঞ্চলে সা কে সুর বলার প্রচলন নেই বললেই চলে । আসলে একটি শব্দ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম ভাব প্রকাশ করে থাকে । লঘু সংগীত কাকে বলে ? শাস্ত্রীয় সংগীত কাকে বলে ? সাধারণত হালকা অঙ্গের গান আধুনিক ,পল্লিগীতি ভাটিয়ালী ইত্যাদি গান গুলো লঘু সংগীত বা দেশীও সংগীত বলা হয় । রাগ , খেয়াল , ধুন ইত্যাদি সংগীত কে উচ্চাঙ্গ বা মার্গ অথবা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বলে । নিত্য বা নাচ কাকে বলে ? নিত্য সংগীতের একটি অংশ বিশেষ ।

 হৃদয়ের ভাব ,তাল , লয় সহযোগে বিভিন্ন প্রকার অঙ্গ ভঙ্গী দিয়ে প্রকাশ করাকে নিত্য বা নাচ বলে ।

নিত্য সাধারণত তিন প্রকার হয়ে থাকে । বাদ্য কাকে বলে ? আমরা জানি সংগীতের একটি বিশেষ অংশ হল বাদ্য । যদিও গীত ও বাদ্য একে অপরের পরিপুরক তবু বাদ্যর আলাদা সংজ্ঞা রয়েছে । সংগীতকে শুধু যন্ত্র দিয়ে শ্রুতিমধুর ভাবে প্রকাশ করাকে বাদ্য বা যন্ত্র সংগীত বলে । উপপত্তিক কাকে বলে ? সংগীতের ব্যকরন সমুহ যেমন – রাগ ঠাট সুর তাল লয় ইত্যাদি সুষ্ঠ রুপে জানাকে উপপত্তিক বলে । তুক কাকে বলে ? কত প্রকার কি কি ? তুক এর জন্মদাতার নাম কি ? তুক একটি মজার জিনিশ । আমরা সকলে তুকের সাথে পরিচিত কিন্তু তুকের পরিচয় জানিনা । গানের পদ বা কলি কে তুক বলা হয় । শাস্ত্রমতে তুক চার প্রকার । ১। স্থায়ী ২। অন্তরা ৩। সঞ্চারী ৪। অভোগ গানের প্রথম অংশকে স্থায়ী বা মুখ বলে । দ্বিতীয় অংশকে অন্তরা , তার পরের অংশ সঞ্চারী , সব শেষ অংশ অভোগ । ইদানীং অধিকাংশ আধুনিক গান গুলোতে সঞ্চারী থাকেনা বললেই চলে । সর্ব প্রথম গান চার ভাগে ভাগ করেন মিঞা তানসেন । এখানে আরও একটি মজার ব্যাপার মিঞা তানসেন এর বাল্য নাম রামতনু । অর্থাৎ মিঞা তানসেন , রামতনু একই ব্যক্তি । অকটেভ কাকে বলে ? ক্রমাশানুযায়ী স হতে র্স পর্যন্ত আট (৮) টি স্বরের সমষ্টি গত নামকে অকটেভ বলে । শুদ্ধ রাগ কাকে বলে ? সে সকল রাগ অন্য রাগের সংমিশ্রণে রচিত নয় সে সকল রাগ গুলোকে শুদ্ধ রাগ বলে । গ্রহ স্বর কাকে বলে ? সে স্বর হতে গীত বা গান আরম্ভ হয় তাকে গ্রহ স্বর বলে । ন্যাস স্বর কাকে বলে ? গায়তে গায়তে যে স্বরে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম নেয়া হয় তাকে ন্যস স্বর বলে । বাদী স্বর কাকে বলে ? রাগের প্রধান স্বর কে বাদী স্বর বলে অর্থাৎ যে স্বর রাগে বেশী ব্যবহার হয় । সমবাদী স্বর কাকে বলে ? রাগের প্রধান স্বর বা বাদী স্বর এর পরেই যে স্বরটি বেশী ব্যবহৃত হয় অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রধান স্বর ই হলো সমবাদী স্বর । বিবাদী স্বর কাকে বলে ? রাগের শত্রু সংখ্যা কে বিবাদী স্বর বলে ? অনুবাদী স্বর কাকে বলে ? রাগের প্রয়োজনীয় বাদী ও সমবাদী ছাড়া বাকি স্বর গুলি হলো অনুবাদী স্বর । বর্জিত স্বর কাকে বলে ? যে স্বর মোটেও ব্যবহার করা হয়না সে স্বর কে বর্জিত স্বর বলে । পকড় কাকে বলে ? রাগের সংক্ষিপ্ত স্বর কে পকড় বলে ? মাত্রা কাকে বলে ? তালের শুক্ষ অংশকে মাত্রা বলে ? একক কাকে বলে ? সময়ের পরিমাপ কে একক বলে ?

বাউল গানে

বাউল গানে





সাধারণত বাউলেরা যে সংগীত পরিবেশন করে তাকে বাউল গান বলে।
বাউল গান বাউল সম্প্রদায়ের সাধনসঙ্গীত। এটি লোকসঙ্গীতের অন্তর্গত। এ গানের উদ্ভব সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। অনুমান করা হয় যে, খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক কিংবা তার আগে থেকেই বাংলায় এ গানের প্রচলন ছিল। বাউল গানের প্রবক্তাদের মধ্যে  লালন শাহ্,  পাঞ্জু শাহ্, সিরাজ শাহ্ এবং  দুদ্দু শাহ্ প্রধান। এঁদের ও অন্যান্য বাউল সাধকের রচিত গান গ্রামাঞ্চলে ‘ভাবগান’ বা ‘ভাবসঙ্গীত’ নামে পরিচিত। কেউ কেউ এসব গানকে ‘শব্দগান’ ও ‘ধুয়া’ গান নামেও অভিহিত করেন। 

বাউল গান সাধারণত দুপ্রকার দৈন্য ও প্রবর্ত। এ থেকে সৃষ্টি হয়েছে রাগ দৈন্য ও রাগ প্রবর্ত। এই ‘রাগ’ অবশ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ নয়, ভজন-সাধনের রাগ। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের মতো বাউল গানে ‘রাগ’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে ‘রাগ’ অর্থে অভিমান এবং প্রেমের নিবিড়তা বোঝায়। কাঙ্ক্ষিতজনের প্রতি নিবেদিত প্রেমের প্রগাঢ় অবস্থার নামই রাগ। রাগ দৈন্যে এমন ভাবই লক্ষণীয়। বাউলরা তাদের সাধনপন্থাকে রাগের কারণ বলে অভিহিত করে (আমার হয় না রে সে মনের মত মন/ আগে জানব কি সে রাগের কারণ)। 

বাউল গান সাধারণত দুটি ধারায় পরিবেশিত হয় আখড়া আশ্রিত সাধনসঙ্গীত এবং আখড়াবহির্ভূত অনুষ্ঠানভিত্তিক। আখড়া আশ্রিত গানের ঢং ও সুর শান্ত এবং মৃদু তালের। অনেকটা হাম্দ,  গজল কিংবা নাত সদৃশ্য। লালন শাহ্র আখড়ায় বসে ফকিররা এ শ্রেণির গান করে থাকে। অপর ধারার চর্চা হয় আখড়ার বাইরে অনুষ্ঠানাদিতে, জনসমক্ষে। এ গান চড়া সুরে গীত হয়। সঙ্গে  একতারা,  ডুগডুগি, খমক, ঢোলক,  সারিন্দা,  দোতারা ইত্যাদি  বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়। তাল দাদরা, কাহারবা, কখনও ঝুমুর, একতালা কিংবা ঝাঁপতাল। শিল্পীরা নেচে নেচে গান করে। কখনও গ্রাম এলাকায় রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে বাউল গানের মাধ্যমে তা নিরাময়ের জন্য প্রার্থনা করা হয়। বাউলরা কখনও একক আবার কখনও দলবদ্ধভাবে সঙ্গীত পরিবেশন করে। এ গানের একজন মুল প্রবক্তা থাকে। তার সঙ্গে অন্যরা ধুয়া বা ‘পাছ দোয়ার’ ধরে। 

বাউল গানে কেউ কেউ শাস্ত্রীয় রাগসঙ্গীতের প্রভাবের কথা বলেছেন। কিন্তু এ গান মূলত ধর্মীয় লোকসঙ্গীতের পর্যায়ভুক্ত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উন্মেষ ও বিকাশ লোকসঙ্গীতের অনেক পরে। আধুনিক শিল্পীদের কণ্ঠে কখনও কখনও রাগের ব্যবহার হলেও তা সর্বক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়। 


বাউল গানে সাধারণত দুধরনের সুর লক্ষ করা যায় প্রথম কলি অর্থাৎ অস্থায়ীতে এক সুর এবং অন্য সব কলিতে কিছুটা ভিন্ন সুর। সবশেষে দ্রুতগতিতে দ্বিতীয় কলির অংশবিশেষ পুনরায় গীত হয়। এ গানে অস্থায়ী এবং অন্তরাই প্রধান। অস্থায়ীকে কখনও ধুয়া, মুখ বা মহড়া বলা হয়। দ্রুত লয়ের এ গানে প্রতি অন্তরার পর অস্থায়ী গাইতে হয়। কোনো কোনো গানে সঞ্চারী থাকে; আবার কোনো কোনো গানে নাচেরও প্রচলন রয়েছে, যার উৎস গ্রামীণ পাঁচালি গান বলে মনে করা হয়। তবে আখড়া আশ্রিত বাউল গানে নাচের প্রচলন নেই। 

কিছু কিছু বাউল গান কীর্তন আশ্রিত। বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে এমনটি হয়েছে। তবে বাউল গানে সুফিভাবনাই প্রবল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে,  পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাউল গানে সুরের পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সহজিয়া বৈষ্ণব সুরের আধিক্য, আর বাংলাদেশে সুফি গজলের প্রভাব, যার একটি দেশজরূপ ভাবগান ও শব্দগান। বাউল গানের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এতে একটা উদাসী ভাব লক্ষ করা যায়; এর সুরে যেন মিশে থাকে না-পাওয়ার এক বেদনা। 

বাউল গানের একটি বড় সম্পদ তার গায়কী বা গায়নশৈলী। উল্লেখ্য যে, বাউল গান একটি বিশেষ অঞ্চলে রচিত হলেও সঙ্গীতশিল্পীদের কারণে এর ওপর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রভাব পড়ে। ফলে সুর ও গায়কিতে আসে পরিবর্তন। কখনও কখনও শব্দেও পরিবর্তন ঘটে। লক্ষ করা গেছে, কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউল গান যখন সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ফরিদপুর, রাজশাহী বা দিনাজপুরে গীত হয়, তখন বাণীর উচ্চারণে, সুরের প্রক্ষেপণে এবং গায়কিতে পরিবর্তন আসে। কিন্তু তারমধ্যেও মূল সুর ও বাণীর মধ্যে কমবেশি ঐক্য বজায় থাকে।

নৃত্যনাট্য


নৃত্যনাট্য



নৃত্যনাট্

নৃত্যনাট্য গীতিনির্ভর নাট্যধর্মী নৃত্য। নানা কাহিনী অবলম্বনে এ নৃত্য নির্মিত হয়। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে গীতবাদ্য সম্বলিত নৃত্যচর্চার উল্লেখ আছে, আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলা যায় নৃত্যনাট্য। রাজা লক্ষ্মণসেনের সভাগায়ক জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ এমনই একটি গীত-বাদ্য-নৃত্য-বহুল রচনা। এতে নৃত্য-গীতসহ নাটকীয়তা আছে বলেই একে নৃত্যনাট্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পরবর্তীকালে নৃত্যনাট্যের এই ধারার বিলুপ্তি ঘটে। আধুনিক কালে নৃত্যনাট্য বলতে যা বোঝায় তার স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সৃষ্ট নৃত্যনাট্য চন্ডালিকা, শ্যামা ইত্যাদি বঙ্গসংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ নৃত্যনাট্যের যে ধারা প্রবর্তন করেছেন, পরবর্তী দীর্ঘকাল যাবৎ সেই ধারাই অনুসৃত হয়েছে। বিশ শতকের মধ্যভাগে সেই ধারার বিবর্তন ঘটিয়ে এর আধুনিকীকরণ করেন উদয়শঙ্কর। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য মূলত গীতপ্রধান এবং উদয়শঙ্করের নৃত্যনাট্য আবহ সঙ্গীত প্রধান। ১৯৬১ সালে কলকাতায় রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকীতে উদয়শঙ্কর রবীন্দ্রনাথের সামান্য ক্ষতি ও অভিসার কবিতাকে সর্বপ্রথম নৃত্যনাট্যে রূপান্তরিত করে দর্শকনন্দিত হয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট অন্যান্য নৃত্যনাট্য কল্পনা (সিনেমা) ও লেবার এন্ড মেশিন আজও অবিস্মরণীয়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা নৃত্যনাট্য রাবীন্দ্রিক ধারা এবং উদয়শঙ্করের আধুনিক টেকনিক দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পাশাপাশি এর সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ফলে নৃত্যনাট্যের বিষয় ও আঙ্গিকগত পরিবর্তনও হয়। বিভিন্ন সময়ের প্রেক্ষাপটে নানান বিষয় অবলম্বন করে অসংখ্য নৃত্যনাট্য তৈরি ও মঞ্চস্থ হয়। বাংলাদেশে তৈরি নৃত্যনাট্যগুলিকে বিষয়গত দিক থেকে দুভাগে ভাগ করা যায়: সামাজিক এবং রাজনৈতিক ও গণনৃত্যনাট্য।


সামাজিক নৃত্যনাট্য ১৯৪৮ সালে রবিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায় ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ইন্দ্রসভা নামে একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেন। এর বিষয়বস্ত্ত ছিল হিন্দু পৌরাণিক দেবতা ইন্দ্রের রাজসভার কাহিনী। সদ্য স্বাধীন মুসলিম প্রধান দেশে এটাই ছিল প্রথম নৃত্যনাট্য। পরে ১৯৫২ সালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের পটভূমিকায় যেন ভুলে না যাই নৃত্যনাট্যটি মঞ্চস্থ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মন জয় করেন। এরপর পারস্য কাহিনী অবলম্বনে হাফিজের স্বপ্ন ও ইরানের পান্থশালা শিরোনামে দুটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেন। ১৯৫৪ সালে এই মহান শিল্পীর মৃত্যুর পর ১৯৫৫ সালে তাঁরই নামানুসারে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় বুলবুল ললিতকলা একাডেমী। এই একাডেমীর প্রযোজনায় পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের অমর কাব্য নক্সী কাঁথার মাঠ নৃত্যনাট্যে রূপান্তরিত হয় এবং জি.এ মান্নানের পরিচালনায় ১৯৫৮ সালে এটি মঞ্চস্থ হয়। এ নৃত্যনাট্যের নায়ক-নায়িকা রূপাই ও সাজুর বিয়োগান্ত প্রেমের কাহিনীতে নানা বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। পরে নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে নতুন নতুন নৃত্যনাট্য রচনা ও মঞ্চায়নের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং নৃত্যশিল্পীরা রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করার প্রয়াস পান এবং এ উপলক্ষে প্রথম মঞ্চস্থ হয় শ্যামা নৃত্যনাট্যটি। প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী আতিকুল ইসলাম সঙ্গীত এবং মন্দিরা নন্দী নৃত্য পরিচালনা করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠন ও শিল্পীদের উদ্যোগে চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা, মায়ার খেলা, চন্ডালিকা, শাপমোচন, ভানুসিংহের পদাবলী, তাসের দেশ প্রভৃতি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়েছে। বুলবুল ললিতকলা একাডেমী ও ছায়ানট এসব নৃত্যনাট্য মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করে। ১৯৬৭ সালে ভারতেশ্বরী হোমসে আমানুল হকের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি।
নৃত্যনাট্য আনারকলিতে বুলবুল ও আফরোজ

রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের এই ধারার অনুকরণে নজরুল ইসলামের জীবনভিত্তিক নৃত্যনাট্য হাজার তারের বীণা রচনা করেন ড. এনামুল হক। এটি প্রযোজনা করে বুলবুল একাডেমী। বাবুরাম সিং ও কাজল মাহমুদ নৃত্য পরিচালনা করেন এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেন আলতাফ মাহমুদ। ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যের পাশাপাশি দেশিয় নানা কাহিনী এবং আবহমান বাংলার লোকগাঁথা নিয়ে বহু নৃত্যনাট্য রচিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে মৈমনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে মহুয়া, সোনাইমাধব, মলুয়া, নদের চাঁদ, চন্দ্রাবতী প্রভৃতি নৃত্যনাট্য তৈরি করেন যথাক্রমে পীযূষকিরণ পাল, যোগেশ দাশ, জি.এ মান্নান এবং নিকুঞ্জবিহারী পাল। এছাড়াও ভারত থেকে আগত বুলবুল একাডেমীর শিক্ষক অজিত সান্যাল বাংলার মানুষের জীবন নিয়ে শ্যামল মাটির ধরাতলে এবং গওহর জামিল রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে সামান্য ক্ষতি ও লোককাহিনী ভিত্তিক কাঞ্চন মালা নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেন।

আলপনা মুমতাজ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের অমর প্রেমগাথা শশীপন্নু ও পারস্য কবি ওমর খৈয়ামের জীবনচরিত অবলম্বনে ওমর খৈয়াম শিরোনামে দুটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেন।

ঢাকার বাইরেও অনেক নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়েছে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রখ্যাত গীতিকার মোঃ মোহসীন রেজার রাজশাহীর আঞ্চলিক কাহিনী অবলস্বনে রূপসী গাঁ ও পদ্মার ঢেউ নামক দুটি নৃত্যনাট্য। এ দুটি বজলুর রহমান বাদলের নৃত্য ও আবদুল আজিজ বাচ্চুর সঙ্গীত পরিচালনায় রাজশাহীতে মঞ্চস্থ হয় যথাক্রমে ১৯৬০ ও ১৯৬৪ সালে। ১৯৬২ ও ১৯৭৬ সালে রুনু বিশ্বাস চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী লোককাহিনী অবলম্বনে আমিনা সুন্দরী, ভেলুয়া সুন্দরী ও মালেকা বানু শিরোনামে নৃত্যনাট্যগুলি চট্টগ্রামে মঞ্চস্থ করেন। সেসময় একই নৃত্যনাট্য বিভিন্ন শিল্পী নৃত্যের মূল আঙ্গিক বজায় রেখে স্বীয় অভিজ্ঞতায় উপস্থাপন করেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রনাথের চন্ডালিকা, শ্যামা, শাপমোচন, চিত্রাঙ্গদা, মায়ার খেলা বাংলার লোকগাঁথা ভিত্তিক রূপবান, গুনাই বিবি, মহুয়া, বেদের মেয়ে, মলুয়া, সোনাইমাধব ইত্যাদি। এভাবে স্থানীয় লেখক ও কবিদের রচিত কিছু নৃত্যনাট্য, যেমন বাদল বরিষণে, কাবেরী তীরে, মুসাফির, জুলফিকার (নজরুলের জীবনভিত্তিক) ইত্যাদি মঞ্চস্থ হয়েছে। আলতামাস আহমেদের পরিচালনায় ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রচিত মানসিংহ ও ঈশাখাঁর কাহিনী অবলম্বনে রচিত বীরাঙ্গনা সখিনা, একটি প্রেম-কাহিনী অবলম্বনে আমানুল হক রচিত সোনা ঝরা সন্ধ্যা এবং এ.কে.এম মুস্তবার রচনা ও পরিচালনায় শতাব্দীর স্বপ্ন (১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পটভূমিকায় রচিত), সুর পেলো সুরভি (দেশের সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ) ও ঝঞ্ঝা (প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার প্রেক্ষাপটে রচিত) নৃত্যনাট্যগুলি ১৯৬৮-৬৯ সময়ের মধ্যে ঢাকার মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়।

রাজনৈতিক ও গণনৃত্যনাট্য ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পটভূমিকায় জি.এ মান্নান কাশ্মীর শিরোনামে একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেন। পরে ১৯৬৬ সাল থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিমন্ডল পুনরায় উত্তপ্ত হতে শুরু করে। এভাবে বারবার রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে বাঙালি সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা অনেকটাই ব্যাহত হয়। তা সত্ত্বেও নৃত্যশিল্পীরা তাদের সৃজনশীল প্রতিভাগুণে নতুন নতুন বাস্তবধর্মী নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন, যাতে বাংলার মানুষের জীবন প্রতিফলিত হয়েছে। এসব নৃত্যনাট্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন ইত্যাদির কথা রয়েছে। এ সময় সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, জোতদার, মজুতদার ও শোষণের বিরুদ্ধে অসংখ্য নৃত্যনাট্য রচিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ড. এনামুল হক রচিত এবং রাহিজা খানম ঝুনু ও বাবুরাম সিং পরিচালিত রাজপথ জনপথ, উত্তরণের দেশে; হাবিবুল চৌধুরী পরিচালিত প্রতিরোধে বহ্নিমান এবং আমানুল হকের রচনা ও পরিচালনায় জ্বলছে আগুন ক্ষেতে খামারে, হরতাল, ওরা কাজ করে ও দিগন্তে নতুন সূর্য। এগুলি সবই বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্বকালে রচিত ও মঞ্চায়িত হয়।

ব্যাটেল অব বাংলাদেশ- এর একটি

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নৃত্যশিল্পীরা নতুন উদ্দীপনায় নৃত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং তাঁদের সৃজনশীল প্রতিভাগুণে নতুন নতুন নৃত্যনাট্য রচিত হয়। সঙ্গত কারণেই সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি প্রাধান্য পায়। নৃত্যনাট্যের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তখন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম নৃত্যনাট্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ প্রাপ্তির সম্মানে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমানুল হকের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়। এর কিছুদিন পর একই পটভূমিকায় নবারুণ শিরোনামে আরেকটি নৃত্যনাট্য যৌথভাবে পরিচালনা করেন জি.এ মান্নান, গওহর জামিল ও আলতামাস আহমেদ।

এ সময় মুস্তফা সরোয়ার রচিত ছয়দফা আন্দোলন ভিত্তিক বিক্ষুব্ধ ৭ই জুন নৃত্যনাট্যটি আমানুল হকের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের একমাত্র সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বরলিপি সংস্কৃতি সংসদ কর্তৃক আয়োজিত ও মাহ্ফুজুর রহমান পরিচালিত গ্রামীণ জীবন-কাহিনী অবলম্বনে ধানসিঁড়ি নদী তীরে নৃত্যনাট্যটি মঞ্চস্থ হয় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে। ১৯৮০ সালের পরে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নৃত্যনাট্য হলো আমানুল হক রচিত ও পরিচালিত ব্যাটেল অব বাংলাদেশ, আমার স্বদেশ আমার ভালবাসা, লায়লা হাসান পরিচালিত বিজয় পতাকা, আকরাম আলী রচিত ও কমল সরকার পরিচালিত স্বাধীনতার স্বপক্ষে, রওশন জামিল পরিচালিত মায়ের মুক্তি, ড. এনামুল হক রচিত ও রাহিজা খানম ঝুনু পরিচালিত সূর্যমুখী নদী ইত্যাদি। এছাড়াও নতুন নতুন আঙ্গিকে বিচিত্র বিষয় অবলম্বনে একাধিক নৃত্যনাট্য রচিত হয়েছে। যশোরের কিংশুক সঙ্গীত একাডেমীর উদ্যোগে শকুন্তলা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর প্রযোজনায় শহীদুল ইসলাম রচিত এবং শামীম আরা নীপা ও শিবলী মোহাম্মদ পরিচালিত চির অম্লান ও মায়ের চোখে পূর্ণিমা নৃত্যনাট্য দুটি মঞ্চস্থ হয় ১৯৯৫ সালে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত রূপবান, ঝংকার ললিতকলা একাডেমীর গুনাইবিবি, জাগো আর্ট সেন্টার আয়োজিত কাঞ্চনমালা ও রাধার মানভঞ্জন, বাংলাদেশ ব্যালে ট্রুপ প্রযোজিত যৌতুক বিরোধী পটভূমিকায় কুসুমের স্বপ্ন প্রভৃতি নৃত্যনাট্য পরিচালনা করেন যথাক্রমে শামীম আরা নীপা, দীপা খন্দকার, আবুল কাশেম, রওশন জামিল, বেলায়েত হোসেন এবং আমানুল হক। এ ছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর বিশেষ ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আগত মি. কিম-এর কোরিওগ্রাফিতে পাশ্চাত্য ব্যালের অনুকরণে রচিত মেঘের আড়ালে সূর্য নৃত্যনাট্যটি মঞ্চস্থ হয়।

মঞ্চনৃত্যনাট্য ছাড়াও বাংলাদেশ টেলিভিশনেও একাধিক নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে রয়েছে নজরুলের কাজরী, রবীন্দ্রনাথের কাব্য অবলম্বনে শাহজাহানের স্বপ্ন, জসীমউদ্দীনের মধুমালতী, জাগরণমূলক সূর্য তোরণ, অরুণাচলের পথে, সার্কভুক্ত সাতটি দেশের প্রতীকে সাতটি তারার দেশ, আরব্য উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে আলীবাবা ও চল্লিশ চোর, গ্রাম্য পটভূমিতে বাঁশরীয়া ও কিষাণীর স্বপ্ন, খরার ওপর ভিত্তি করে মেঘ রাজা মেঘ দে, জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা অবলম্বনে আমার প্রিয়াকে নিয়েছে কেড়ে, গ্রাম্য প্রেমের কাহিনী অবলম্বনে মন বেসাতির হাটে, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় ওরা এ মাটির সন্তান ইত্যাদি। এগুলি পরিচালনা করেছেন যথাক্রমে জিনাত বরকতউল্লাহ, মোস্তফা মনোয়ার, জি.এ মান্নান, রাহিজা খানম ঝুনু, বরকতউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা খান এবং আমানুল হক।

একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, দেশে যখনই কোনো সংকট এসেছে কি রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক বা সাংস্কৃতিক, শিল্পীরা তাৎক্ষণিকভাবে সেসব বিষয়ের ওপর নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন; নানা রকম উপকরণ ও টেকনিকের সাহায্যে সৃষ্টি করেছেন মানসম্পন্ন নৃত্যনাট্য, যা কেবল বৈভবে নয় বৈচিত্র্যেও সম্পদশালী। এসব নৃত্যনাট্য সঙ্গীত, তাল, রস সব দিক থেকে দর্শকদের কাছে উপভোগ্য হয়েছে। [আমানুল হক
]

বিশ্বের সেরা ১০ পর্ণ স্টার এবং তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী পর্ন তারকা তিনি

বিশ্বের সেরা ১০ পর্ণ স্টার এবং তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় বিশ্বের সেরা ১০ পর্ণ স্টার এবং তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ২০১৪ সালে পর্ণ জগতে আসা মিয়া খলিয়া...